“…গঙ্গারামকে পাত্র পেলে, জানতে চাও সে কেমন ছেলে?” নাহ, এ গঙ্গারামকে পাত্র হিসাবে কেউ চাইবে না। কারণ এ গঙ্গারাম তো মানুষই নয়৷ তবে সুকুমার রায়ের কবিতার মত অত হেলাফেলার পাত্র সে নয়৷ বরং সকলের চোখের মণি সে। কিন্তু কে এই গঙ্গারাম। আসলে সে আস্ত এক কুমির৷ আর এই কুমিরকেই প্রায় মাথায় করে রাখত গ্রামবাসীরা। নাহ, একেবারেই কোনও রূপকথার গল্প নয়৷ বরং রীতিমতো বাস্তব এক কাহিনী। ছত্তিসগড়ের রাজ্যের ঘটনা।
ছত্তিসগড়ের রাজধানী রায়পুর থেকে প্রায় ৮০ কিলোমিটার দূরের এক গ্রাম বাওয়ামোহাত্রা। চারিদিকে সবুজে ঘেরা এই গ্রামের ঠিক মধ্যিখানে রয়েছে এক মস্ত বড় দীঘি। এই দীঘিতেই বাস করত সে। ১৩০ বছরের কুমির গঙ্গারাম। গ্রামবাসীদের বড় আদরের ছিল সে। তবে সে কিভাবে এখানে এল তা কেউই জানে না। তবে প্রায় তিন প্রজন্ম আগে থেকেই সে ছিল এখানে এটুকুই যা জানা যায়। অন্যান্য কুমিরের মত একদমই ছিল না সে। সে ছিল খুবই সংবেদনশীল। গ্রামের বাচ্চাদের খেলার সঙ্গী। বাচ্চারা নির্ভয়ে তার পিঠে চেপে দীঘি পারাপার করত। কারুর কিচ্ছু ক্ষতি করত না সে। এমনকি দীঘিতে কোনও প্রাপ্তবয়স্ক মহিলা বা পুরুষ স্নান করতে নামলে লজ্জা পেয়ে উল্টোদিকের ডাঙায় উঠে যেত গঙ্গারাম। হ্যাঁ, ঠিক এতটাই বোঝদার ছিল সে৷ এভাবেই গ্রামবাসীদের একদম ঘরের লোক, কাছের মানুষ হয়ে উঠেছিল গঙ্গারাম। যখন তার খিদে পেত জলের মধ্যে বুড়বুড়ি কাটত সে এবং গ্রামবাসীরা ঠিক বুঝতেও পারতেন না। ভাত, ডাল ইত্যাদি পরম যত্নে সাজিয়ে তার জন্য রেখে আসতেন তারা সবাই। ঠিক এভাবেই গঙ্গারাম হয়ে উঠেছিল তাদের আরাধ্য দেবতা, তাদের রক্ষাকবচ। রীতিমতো ভক্তি ভরে তাকে পুজোও করতেন গ্রামবাসীরা।
কিন্তু হঠাৎই একদিন ঘটে ছন্দপতন! গতবছরের ৮ই জানুয়ারি৷ রোজকার মত সেদিনও দীঘিতে স্নান করতে নেমেছিলেন কোনও এক গ্রামবাসী। সেইসময় গঙ্গারামকে জলে ভেসে থাকতে দেখেন তিনি। বহুক্ষণ কেটে যাওয়ার পরও কোনও সাড়াশব্দ না পেয়ে সন্দেহ জাগে তার। তিনি গিয়ে অন্যান্য গ্রামবাসীদের খবর দিলে সবাই ছুটে আসেন। তারপর সকলের মিলিত প্রচেষ্টায় পাড়ে তোলা হয় গঙ্গারামের নিথর দেহ৷ এরপর বনদপ্তরের লোকজন এসে জানান বার্ধক্যজনিত কারণেই মারা গেছে সেই কুমির। তার মৃতদেহ জড়িয়ে গ্রামবাসীদের সে কি কান্না! গঙ্গারামকে ফুল ও মালায় সাজিয়ে ট্রাক্টরের শুইয়ে চোখের জলে শেষ বিদায় জানান সবাই। গ্রামেরই এক পাশে সমাধি দেওয়া হয় তাকে।
তবে সে গ্রামের মানুষ এখনও মনে করেন গঙ্গারাম তাদের সঙ্গেই রয়েছে সবসময়। গ্রামের মোড়ল জানান, তার সমাধির ওপরে একটি স্মৃতি সৌধ বানানো হবে। সেখানে গঙ্গারামের একটি মূর্তিও থাকবে। কুমিরটির স্মরণে এমনকি গ্রামটির নতুন নামকরণ হবে ‘মগর মাচ্ছা ভালা গাঁও’ নামে। গ্রামবাসীদের সরল বিশ্বাসে এভাবেই বেঁচে থাকবে গঙ্গারাম। বিপদে রক্ষাও করবে তাদের। আসলে চারিদিকে এত হিংস্রতার মাঝেও একমাত্র ভালোবাসাই পারে কারোর মন জয় করতে৷ ভালোবাসার মাধ্যমেই গঙ্গারামের মতো এক কুমিরও হয়ে উঠতে পারে আপনজন। পৃথিবীর জুড়ে তথাকথিত শিক্ষিত কিছু মানুষ যখন হানাহানিতে মত্ত, তখন ভারতের এক অখ্যাত গ্রামের সরল সাধাসিধে মানুষগুলিই ভালোবাসা দিয়ে কাছে টেনে নিতে পারে অখ্যাত কিছু প্রাণীকে। তাদের আদরের ধন হয়ে ওঠে সে। আসলে বিপুলা এ পৃথিবীর কতটুকুই বা আমরা আর জানি! তবে আমাদের চারপাশে থাকা কিছু অবলা জীবকে তো এভাবেই ভালোবাসা, মায়া দিয়ে কাছে টেনে নেওয়াই যায়। হয়তো ভবিষ্যতে তারাও হয়ত গঙ্গারামের মতই আমাদের কাছের মানুষ হয়ে উঠতে পারে। এটুকু চেষ্টা তো আমরা করতেই পারি, তাই না? ক্ষতি কী!
কলমে অন্তরা ঘোষ
চিত্র ঋণ – inextlive.jagran.com, indiatoday.in
Discussion about this post