বছর শেষ হতে আর কদিন বাকি? পিচ গলা রাস্তায় চৈত্র মাসের ভরদুপুরে হঠাৎ দেখা শিব ঠাকুরের সাথে। ছাই রঙা গায়ে কমলা রঙের চুল। সাঙ্গপাঙ্গের সঙ্গে রাস্তার মাঝে সে এক ছোটোখাটো জমায়েত। তাঁদের মাঝে কেউ গান গায়, কেউ মুখোশ পড়ে নাচে, কেউ ঢোল বাজায়। যুগ যুগ ধরে ‘গম্ভীরা’র এমনই রূপের সঙ্গে পরিচিত গৌড়বঙ্গ।
‘গম্ভীরা’ শব্দের উৎপত্তি, ব্যাখ্যা, আবর্তন সবকিছুই ‘গম্ভীর’কে ঘিরে। ‘গম্ভীর’ অর্থে স্বয়ং মহাদেব! সমাজের সমস্যা প্রতিকারে স্বয়ং উপস্থিত তিনিই। খানিক যেন ঘরের দোরগোড়ায়। বর্ণে-ছন্দে-গীতিতে চলতে থাকে সমস্ত প্রতিকার বর্ণনা। তবে এটুকু বললে খানিক অসম্পূর্ণ থাকে। দেবাদিদেবের মাহাত্ম্য, শিব-পার্বতীর বিয়ে অনেক কিছুই জানানো হয় গম্ভীরার গানে। সঙ্গে থাকে মুখোশধারী শিল্পীদের নৃত্য পরিবেশন। ‘মুখোশ’ গৌড়বঙ্গ, বরেন্দ্রভূমির লোকসংস্কৃতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। এই কাঠের মুখোশ ব্যতীত তাদের ঐতিহ্যের একটি বড়োসড়ো অংশে ফাঁক থেকে যায়। আর এই ফাঁক থাকাটাই স্বাভাবিক, কারণ এই ঐতিহ্য তো একদিনের নয়। সেও নিজেই ঐতিহাসিক। পাল-সেন যুগ অতিক্রম করে একবিংশ শতাব্দীতে সেও এসে পৌঁছেছে। শ্রী চৈতন্যদেব স্বয়ং গম্ভীরার দর্শক ছিলেন। তবে? গম্ভীরের পুজোকে ঘিরে এই লোকসংস্কৃতি কয়েকশো বৎসর পুরনো হলেও, নতুন বছর আমন্ত্রণ তাকে ছাড়া ফিকে।
চারদিনের উৎসব ‘গম্ভীরা’, বর্ষশেষের গাজনের ‘প্রায়’ সমার্থক। চারদিনের উৎসবে চারটি ভিন্ন আচার-অনুষ্ঠান। প্রথমদিনে ‘ঘর ভরা’। শিব ঠাকুরের উদ্দেশ্যে ঢাকঢোলের তালে নদী থেকে ঘটে জল এনে গম্ভীরা মন্ডপে স্থাপন করা হয়। দ্বিতীয় দিন ‘তামাশা’র দিন। আনুষ্ঠানিক নাম ‘ছোটো তামাশা’। এদিন শিব-পার্বতীর পুজো হয়। তৃতীয় দিন ‘বড়ো তামাশা’। মুখোশ পড়ে ঢোল-বাদ্যির তালে তালে নাচতে থাকে গম্ভীরার শিল্পীরা। গম্ভীরার আসল রূপ প্রকাশ পায় এইদিন। আর চতুর্থদিন ‘আহারা উৎসব’। বিভিন্ন সাজে সঙ সেজে চলতে থাকে শহর-নগর পরিক্রমা। মহাদেবের বন্দনার পাশাপাশি চলতে থাকে গান-অভিনয়ের মাধ্যমে সামাজিক সমস্যার প্রতিকার বিশ্লেষণ।
তবে বিশ্বায়নের সময়ে অন্যান্য লোকশিল্পের মতোই ধীরে ধীরে তার নিজস্ব রূপ হারাতে বসেছে গম্ভীরাও। সংরক্ষণ না করা হলে সেও হয়তো হারিয়ে যাবে। শিল্পীদেরও যথেষ্ট সম্মান করা প্রয়োজন। গম্ভীরার সময় বাদে অনেকেই বছরের বাকি সময় রিক্সা টানে। অথবা দিন মজুর। সুতরাং, গম্ভীরাকে লোকশিল্প হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে! এই ভাবনাও যেন ভাবনাতীত। পেট যেখানে অভুক্ত , শিল্প সেখানে বিলাসিতা ছাড়া আর কীই বা হতে পারে!
Discussion about this post