ধূসর শহরের মধ্যিখানে একটি পার্ক। অন্য আর চার-পাঁচটা শহুরে পার্কের থেকে এই পার্ক কিন্তু আলাদা। এখানে গাছপালা আছে, ফুল আছে, সকালের মর্নিংওয়াক আছে, বিকেলে কচিকাঁচাদের হুল্লোড় আছে। এসব তো অন্য পার্কেও থাকে। এইসবের মধ্যে এই পার্কে আছে একটা আস্ত ফ্রি লাইব্রেরি। প্রায় দশ বছরের পুরনো এই লাইব্রেরিতে আছে দশ হাজারের বেশি বই, পত্রিকা। এখানে নিয়মিত পড়াশোনা করে দুঃস্থ এবং অনাথ ছেলেমেয়েরা। আর এই সমস্ত কাজ করেন, এই পার্কের নিরাপত্তাকর্মী ৫৪ বছরের সত্যরঞ্জন দলুই।
উত্তর কলকাতার জগৎ মুখার্জি পার্কের মধ্যেই অবস্থিত সত্যরঞ্জন দলুইয়ের এই ফ্রি লাইব্রেরি। পাথরপ্রতিমার লক্ষ্মীপুর গ্রামের বাসিন্দা সত্যরঞ্জন বাবু কলকাতা চলে এসেছিলেন ১৯৮৯ সালে। পরিবারের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হওয়ায় তাঁকে ক্লাস ১০এর পরেই চাকরির রাস্তা দেখতে হয়েছিল। ২০১০ সালে তিনি উত্তর কলকাতার ৮ নং ওয়ার্ডের জগৎ মুখার্জি পার্কে সিকিউরিটি গার্ডের চাকরি পান। সেই সময় থেকেই সত্যরঞ্জন বাবু লাইব্রেরি তৈরির কাজ শুরু করেন।
২০১০ সাল থেকে সত্যরঞ্জন বাবু নিজের সামান্য মাইনের টাকাতেই বইপত্র কিনতেন। পত্রিকা, খবরের কাগজ রাখা শুরু করেছিলেন। নিজেই সাইকেল করে বই সংগ্রহ করে বেড়াতেন তিনি। বর্তমানে অনেকে নিজেরাই বই দান করেন। আজ তাঁর লাইব্রেরিতে ১০ হাজারের বেশি বই রয়েছে। সত্যরঞ্জন বাবুর দুই কুকুর টাইগার এবং স্কুবি দিনরাত বই পাহারা দেয়। তবে বইয়ের সংখ্যা বাড়লেও সত্যরঞ্জন বাবুর মাইনে কিন্তু বিশেষ বাড়েনি। তবু তিনি লাইব্রেরি দেখাশোনার জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ব্যয় করে থাকেন প্রতিমাসে।
সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে গরিব ছেলেমেয়েদের জন্য সত্যরঞ্জন বাবু তৈরি করেছিলেন এই লাইব্রেরি। তবে এখানে এসে পড়াশোনা করতে পারেন সকলেই। পরিত্যক্ত কাঠ এবং বাতিল অ্যাকোরিয়াম দিয়ে তৈরি তাঁর বইয়ের তাকে লেগে থাকে যত্ন আর আন্তরিকতা। দৈনন্দিন জীবনের রোজনামচার পাশাপাশি তাঁর লাইব্রেরি থেকে শোনা যায় পথশিশুদের কবিতা পাঠ। ইটকাঠের শহরে ছোট্ট এই পার্কের গাছপালারাও যেন গা-ঝাড়া দিয়ে নেচে ওঠে তখন। সত্যরঞ্জন বাবু বলেন, “সামান্য সিকিউরিটি গার্ড যদি এতটা এগোতে পারে, শিক্ষিত ছেলেমেয়েরাও পারবে, এভাবেই তৈরি হবে একটা নতুন পৃথিবী।’’
Discussion about this post