সবুজ যুদ্ধ করে একা একটা আস্ত অরণ্য উপহার দেওয়া কী আর মুখের কথা! লেগেছিল চল্লিশটা বছর। দৃঢ় সংকল্পের এই কাহিনী জানতে হলে পিছিয়ে যেতে হবে অনেকগুলো বছর আগে। কীভাবে সাধারণ এক গোয়ালা পরিবারের ছেলে যাদব হয়ে উঠলেন বাস্তবের ‘অরণ্যদেব’, সেই গল্পই জানা যাক আজ।
১৯৬৫ সাল। অসমের ব্রহ্মপুত্র নদের বুকে ভাসছিল ছোট্ট একটি দ্বীপ অরুণা সাপোরি। কিন্তু ভূমিধ্বসের কারণে ধীরে ধীরে গ্রাস করছিল ব্রহ্মপুত্র। ভয়ে সেই দ্বীপ ছেড়ে ১২ কিলোমিটার দূরে মাজুলি দ্বীপে চলে যায় বহু পরিবার। চলে যায় যাদব পায়েংও। দীর্ঘ ১৩ বছর পর ১৯৭৮ সালে জন্মস্থানে ফিরল যাদব পায়েং। কারণ বাবা মা মারা যাওয়ার পর পরিবারের হাল ধরতে হতো তাকেই। ইচ্ছে ছিল, পড়াশোনা ছেড়ে গ্রামের পারিবারিক দুধের ব্যবসা দেখবে সে। কিন্তু ফিরে যা দেখল সে, তা ছিল দুঃস্বপ্নের মতোই। সবুজের লেশমাত্র নেই দ্বীপে। বনজঙ্গল সাফ করে দিয়েছে মানুষের লোভ আর ব্রহ্মপুত্রের খামখেয়ালি গতিপথ। ধূ ধূ মরুভূমির মতো দ্বীপজুড়ে মরে পড়ে আছে কয়েক হাজার সাপ। গ্রামে ফিরে গ্রামবাসীদের কাছে সাপ ও দ্বীপের করুণ অবস্থার কথা বলে ১৬ বছরের কিশোর যাদব। এক বৃদ্ধ গ্রামবাসী তার হাতে তুলে দেন কিছু চারাগাছ। বলেন, “গাছ লাগাও বাবা। তাহলে শুধু সাপ কেন, আমরা সবাই বাঁচব।” সেই থেকে শুরু যাদব পায়েংয়ের অরণ্য অভিযান।
বৃদ্ধের দেওয়া গাছের চারাগুলি প্রথমে সে তার খামারের পাশেই বসায়। যাতে রোজ জল দেওয়া যায়। তারপর বিভিন্ন গ্রাম ঘুরে জোগাড় করে হাজার হাজার বীজ। আগামী ৪০ বছর এপ্রিল থেকে জুন, এই তিনমাস ধরে চলতে থাকে তার সবুজ বিপ্লব। নিজের হাতে লাগানো গাছ থেকে ডাল কেটে সেই ডাল নিয়ে নদী পেরিয়ে নদীর চারপাশে সেই ডাল বসানোও ছিল তার রোজনামচা। যার ফলস্বরূপ ৫৫০ হেক্টর বা ১৩৬০ একর জুড়ে গড়ে ওঠে যাদব পায়েংয়ের অরণ্য, যা কিনা নিউইয়র্কের সেন্ট্রাল পার্কের থেকেও বড়ো। ধীরে ধীরে এই অরণ্যে বাড়তে থাকে বাঘ, হরিণ, হাতি, গন্ডারদের আনাগোনা। স্থানীয় মানুষ সেই জঙ্গলের নাম দেয় ‘মোলাই কাঠনিবাড়ি’। ২০১২ সালে প্রকৃতির প্রতি তাঁর এই অসামান্য অবদানের জন্য জওহরলাল নেহেরু বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে ‘Forest man of India’ শিরোপা দেয়। ওই বছরই ভারতের তৎকালীন প্রেসিডেন্ট প্রণব মুখার্জী মুম্বইয়ে যাদব পায়েংকে আর্থিকভাবে পুরস্কৃত করেন। ২০১৫ সালে পান পদ্মশ্রী পুরস্কার। তবে পুরস্কার হিসেবে পাওয়া সমস্ত অর্থ তিনি ব্যয় করেছেন বনসৃজনের জন্য।
যেখানে আগে ধূ ধূ করত বালির চর, সেখানে এখন অবস্থান করছে বাঁশ, বহেরা, সেগুন, কাস্টার্ড আপেল, গুলমোহর, তেঁতুল, তুঁত, কাঁঠাল, কুল, জাম গাছের এক ঘন জঙ্গল। আর এর কারিগর একমাত্র ‘মোলাই’। হ্যাঁ, স্থানীয় মানুষদের কাছে এই নামেই পরিচিত যাদব। এত বছর পরেও থেমে থাকেননি।এখনও সময় পেলেই নিজের হাতে লাগান গাছ। সযত্নে বড়ো করে তোলেন। পাশাপাশি এক বন্ধুর সঙ্গে বৃক্ষরোপণের কৌশল নিয়ে বই লেখায় মনোনিবেশ করেছেন তিনি। উদ্দেশ্য, ছোটোদের ছোটো থেকেই গাছ লাগানোর প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে অবহিত করা। ভালো কিছু করার উদ্দেশ্য, অদম্য সাহস ও ইচ্ছাশক্তি থাকলে যে কোনোকিছুই অসম্ভব নয় যাদব পায়েং তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
Discussion about this post