বন্ধুবান্ধব বা বিশেষ মানুষটির সাথে নিরিবিলিতে কিছুটা সময় কাটাতে কে না চায়। সাথে যদি থাকে একটু খাওয়া দাওয়ার প্ল্যান, তবে প্রথমেই কি মাথায় আসে বলুন তো? সুন্দর সাজানো গোছানো বেশ আভিজাত্যে ভরপুর এক ক্যাফে বা সিসিডি। কিন্তু বাঙালির সেই চায়ের কেবিন? আজও কি তার অস্তিত্ব রয়েছে? এক কাপ চায়ের সাক্ষাৎকারী প্রেমালাপ কি আজও খোঁজে, কলকাতার সেই কেবিনগুলোকে?
৬৯বি, সূর্য সেন স্ট্রীট। ১০২ বছরের পুরোনো এক রেস্টুরেন্টে। নাম ফেভারিট কেবিন। ১৯১৮ সালে সুদূর চট্টগ্রাম থেকে কলকাতায় আসেন দুই ভাই। নূতন চন্দ্র বড়ুয়া ও গৌর চন্দ্র বড়ুয়া। কলকাতার বুকে খোলেন এক কেবিন। আজও ঠিক একইভাবে কেবিনটি তার অস্তিত্ব বাঁচিয়ে রেখেছে এখানেই। বর্তমান বংশধর সৈকত বড়ুয়া সেটিকে পরিপাটি করে গুছিয়ে রেখেছেন। যেখানে আজও কয়লার রগরগে আঁচে লোহার জালি পেতে সেঁকা হয় টোষ্ট। বড়ুয়ারা বৌদ্ধ তাই ডিমের কোনও পদ থাকে না। কিন্তু প্যান কেক, চা, লেবু চা এসবের বিপুল সম্ভার। আড্ডা দেওয়ার মতোই এক জায়গা। তার সাথে রয়েছে কিছু এমন কিছু স্মৃতি মেশানো আবেগ, যা হয়ত অন্য কোথাও পাওয়া অসম্ভব। যেমন এই ঘরের ভেতরে উনুনের কাছে বসে একসময় স্বদেশীদের মিটিং চলত। এমনকি স্বদেশীদের পালানোর জন্য গুপ্ত দরজাটি আজও একইরকম রয়েছে।
প্রেসিডেন্সিতে পড়াকালীন নেতাজী এখানে প্রায়ই আসতেন। সূর্য সেনও বেশ কয়েকবার এসেছেন এখানে। জানলার ধারে চার নং পাথরের টেবিল। ওটি ছিল কবি নজরুলের জন্য বাঁধা। এখানে বসেই কত না গান কবিতা বেঁধেছেন তিনি। সঙ্গী ছিলেন শিবরাম চক্রবর্তী, প্রেমেন্দ্র মিত্র, অভিনেতা জহর রায় প্রমুখেরা। অচিন্ত্য কুমারের কল্লোল যুগের স্মৃতি রোমন্থনে উঠে আসে এই কেবিনের কথা। সংবাদমাধ্যমের এক প্রতিবেদনেও, নিয়মিত খদ্দের সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের অভিযোগও রয়েছে। যেখানে তিনি এখানের চা-এর মূল্যবৃদ্ধি নিয়ে প্রতিবাদ জানান। একসময় সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায়ও যেতেন দেদার আড্ডা জমাতে।
শুধুমাত্র এটিই নয়। আরও কয়েকটি কেবিন আজও তার পূর্বধারা বজায় রেখে কলকাতার বুকে দাঁড়িয়ে। হাজারও আবেগে মিশে এই কেবিনগুলো। যার চাকচিক্য হয়ত নেই, কিন্তু রয়েছে ঐতিহ্য ও প্রাণের পরশ। আর বাঙালি তো চিরকালই ঐতিহ্যের কদরে খামতি রাখে না। তাই আজও এই কেবিনগুলো শহুরে ঠাঁটবাটের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চলেছে। কিছু পরিবর্তন এসেছে, যেমন কাঠের চেয়ার সরিয়ে প্লাস্টিকের চেয়ার বসেছে। কিন্তু মলিন হয়নি বাঙালির হৃদয় ঘেঁষা সেই পুরনো আবেগ। হারিয়ে যায়নি ইতিহাসের গৌরবময় অধ্যায়গুলোর গন্ধটা।
Discussion about this post