“রাম বাঙালি ভগবান নয়”, বর্তমান রাজনৈতিক প্রেক্ষিতে এই শব্দ বন্ধনীটি বাংলায় বেশ প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠলেও এই ন্যারেটিভের সাথে একমত হওয়া যায় না। কারণ এটি যতটা সত্য ঠিক ততটাই মিথ্যা। এর উত্তর দেওয়া সাদা কালোয় সম্ভব না। কাজেই এই ন্যারেটিভটির সঠিক বিশ্লেষণ করার জন্য বাল্মিকী রামায়ণ, কম্ব রামায়ণ (তামিল), দাণ্ডী রামায়ণ (উড়িয়া), শ্রীরাম পাঁচালী (বাংলা), রামচরিতমানস (অবধী) ও তার সাথে কন্নড় ও তেলুগু লোককথা ও অদ্ভুত রামায়ণও অধ্যয়ন করা দরকার। সেই সঙ্গে মধ্যযুগের বাংলার মন্দির স্থাপত্যের স্টাডিও দরকার। এই সব কয়টি দিক থেকে আমার এক সম্যক উপলব্ধি জন্মেছে রামায়ণ ন্যারেটিভের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে।
ঊর্দুতে একটি কথা রয়েছে ‘سلیقہ’ বা ‘সলিকা’, যাঁর অর্থ হল কোনও কার্য করার কায়দা বা স্টাইল। আমাদের ভারতীয় পুরাণ পড়ার কায়দা ও তা পড়ার মাইন্ডসেট শেক্সপিয়র বা আধুনিক সাহিত্য পড়ার মাইন্ডসেটের থেকে আলাদা হবে কারণ দুই ধরনের সাহিত্যের ভাব আলাদা । তাই তিনটি জিনিস ভারতীয় পুরাণ ও মহাকাব্য পড়ার সময় মনে রাখতে হবে, ১) ইতিহাস ও হিস্ট্রি এর পার্থক্য ২) গল্পের নায়ক কোনও ব্যক্তি নন ৩) শুধুমাত্র লিখিত উৎস ব্যবহার করে আলোচনা সম্ভব না।
এই লেখায় বহুবার আমি ‘ইতিহাস’ কথা উল্লেখ করতে যাচ্ছি, কিন্তু এই ইতিহাস কিন্তু history এর সাথে সমার্থক না। বর্তমানে এই দুই কথাকে আমরা interchangably ব্যবহার করলেও history, পশ্চিমা প্রসঙ্গে এটি হল ‘অতীতের ঘটনার একটি account,’ কিন্তু সংস্কৃতে ‘ইতিহাস’ তৎসম শব্দের অর্থ, “পুরাতন ঘটনার থেকে প্রাপ্ত শিক্ষা।” অর্থাৎ history হল বেশি বস্তুগত ও ইতিহাস হল ভাবার্থক। রামায়ণ ও মহাভারত হিস্ট্রি না, কিন্তু ইতিহাস বটেই।
আমাদের মনে রাখতে হবে যে পুরাণ যখন আমরা পড়ব, সেখানে মূল উপজীব্য হল ‘কর্ম’। শেক্সপিয়রের সাহিত্যে ‘ঘটনা’ প্রভাবিত করে মানুষের কর্মকে। কিন্তু ভারতীয় পুরাণে মানুষের কর্মের দ্বারা ‘ঘটনা’ প্রভাবিত হয়। ভারতে আগে নায়ক বা Hero-এর ধারণা ছিল না। ভারতীয় পুরাণের মূল নায়ক হল কর্ম। সেই কারণে কৃষ্ণ কংসকে হত্যা করলেও কৃষ্ণের কর্মের ফলে মথুরা ধ্বংস হয়। নিজের মামাকে হত্যা করা পাপ। রাম যেহেতু রাবণকে হত্যা করে মন্দোদরীকে বিধবা বানিয়েছিলেন, সেই কারণে রামও অযোধ্যায় ফিরে নিজের স্ত্রীর সাথে এক হতে পারেননি কোনদিনও, সেটি রামের কর্মফল। তাই বাল্মিকী ভেবেছিলেন মহাকাব্যের নাম কী দেবেন? তার মাথায় দুটো নাম ছিল, ‘রামায়ণ’ অথবা ‘রাবণচরিতম’ কারণ এখানে কর্ম দেখানো হচ্ছে। রাবণের কর্ম ও রামের কর্মের মধ্যে তুলনা হচ্ছে। রামায়ণ নিয়ে যখন আলোচনা করা হবে, তখন শুধু লিখিত রামায়ণ নিয়ে আলোচনা সম্ভব না। আলোচনা করতে হয় ‘রামায়ণ সংস্কৃতি’ নিয়ে, যাঁর একটি অংশ হল লিখিত রামায়ণ। অন্য অংশগুলি হল লোকসংস্কৃতি, লোকসঙ্গীত, চিত্রকলা, ভাস্কর্য, নাটক ইত্যাদি।
বাল্মীকি রামায়ণ ও রামায়ণের টাইমলাইন
আমরা সর্ব পুরাতন লিখিত রামায়ণ বলতে বাল্মীকি রামায়ণ ধরি, কিন্তু রামায়ণের মৌখিক ও লৌকিক ইতিহাস তাঁরও অনেক আগের পুরনো। দুটি গল্প প্রমাণ করে যে বাল্মীকি কখনোই নিজেকে রামায়ণের স্রষ্টা বলে জাহির করেননি। তারই একটি উদাহরণ স্বয়ং বাল্মীকি রামায়ণ ও অন্য একটি লোককথা থেকে আসে। লোককথা শুনে নাক সিঁটকালে চলবে না। আগেই বলেছিলাম যে রামায়ণ বুঝতে গেলে রামায়ণ সংস্কৃতি বুঝতে হবে, শুধু লিখিত কাব্য নয়। প্রথমে আসি লোককথায়, বাল্মীকির একবার সাক্ষাৎ হয় স্বয়ং হনুমানের সঙ্গে। তিনি তখন দেখলেন যে হনুমান রাম কথা লিখছেন। সেটি পড়ে বাল্মীকি কান্নায় ভেঙে পড়লেন, কারণ হনুমান এত সুন্দর লিখেছেন যে সেটা কেউ পড়লে আর কেউ বাল্মীকির রাম-কথা পড়বে না। বাল্মীকির কষ্ট বুঝতে পেরে হনুমান যে কলাপাতায় রাম-কথা লিখছিলেন, সেটি চিবিয়ে খেয়ে ফেলেন ও বাল্মীকিকে জায়গা করে দেন।
অন্য একটি উদাহরণ বাল্মীকি রামায়ণে রয়েছে। ঠিক যখন রাম সাধুবেশে প্রাসাদ ত্যাগ করতে যাবেন, তখন লক্ষ্মণ ও সীতাও জেদ ধরেন সঙ্গে যাওয়ার। রাম তাঁকে বারণ করলে সীতা একটি কথা বলেন রামকে, “প্রত্যেক রামায়ণে আমি আপনার সাথে যাই, এই রামায়ণেও তাঁর অন্যথা হবে না”। এই কথা বলে বাল্মীকি কী নিজেই বুঝিয়ে দিচ্ছেন যে তাঁর রামায়ণ একমাত্র রামায়ণ নয় ও রামায়ণের ন্যারেটিভ অসংখ্য হতে পারে? কেউ অবশ্য এই কথার মানে খুঁজতে কালচক্রের উদাহরণ টেনে আনেন। কারণ সত্য, ত্রেতা, দ্বাপর ও কলি চক্রবৎ ঘুরছে ও প্রত্যেক ত্রেতায় রামায়ণ সংগঠিত হচ্ছে ও প্রত্যেক দ্বাপরে মহাভারত। দুটি তত্ত্বই বিশ্বাসীদের মধ্যে উপস্থিত ও এখানে কিছু ঠিক বা ভুল নয়, দুই দর্শনই সন্মানের যোগ্য। তবে আমাদের মাথায় রাখতে হবে যে এই যুগগুলি পৌরাণিক ইতিহাস, হিস্ট্রি নয়।
আগেও আমি প্রশ্ন বাণে বিদ্ধ হয়েছি যে কেন আমরা বাল্মীকি রামায়ণ কেই শুধু আসল রামায়ণ ধরতে পারি না? কারণ এটাই, যে রামায়ণের ন্যারেটিভ অনেক এবং স্বয়ং বাল্মীকি তা স্বীকার করেন। অন্যান্য রামায়ণকে যথেষ্ট সন্মান দিলে মহামুনি বাল্মীকির প্রতি আমাদের শ্রদ্ধা খাটো হয় । বাল্মীকির রামায়ণ ‘ইতিহাস’ মতে লেখা ত্রেতা যুগে। তখন রাম ভগবান ছিলেন না, ছিলেন সাধারণ এক রাজকুমার। তাই বলে রামের অবতারত্ব অস্বীকার করার দুঃসাহস আমার নেই, তিনি ছিলেন মানব অবতার। বিষ্ণু পুরাণ ও ভাগবত সেই কথাই বলে ।
বাল্মীকির রামায়ণ যুগে যুগে ব্যবহৃত হয়েছে ক্ষত্রিয়দের নীতি শিক্ষা দিতে। দ্বাপর যুগে যখন যুধিষ্ঠির বনবাস ও অজ্ঞাতবাস কাটাতে কাটাতে ক্লান্ত, তখন যুধিষ্ঠিরের দেখা হয় মার্কণ্ডেয় মুনির সঙ্গে। যুধিষ্ঠির তাঁকে তার দুরবস্থার কথা জানালে ঋষি তখন যুধিষ্ঠিরকে রাম-কথা শোনান এবং বলেন, তোমার কাছে তোমার সম্পূর্ণ পরিবার আছে। মাতা তোমার সাথে ও পিতাগণ সর্বদা তোমার সহায় এই তেরো বছরের বনবাসে, কিন্তু ত্রেতা যুগের রাজপুত্র রামকে দেখ, তিনি কিছু অধর্ম করেন নি, তবু তাঁর মা ও বাবাকে ছেড়ে তিনি জঙ্গলে কাটালেন। তাঁর পত্নী অপহৃত হলেন, কিন্তু তাও তিনি অধৈর্য হয়ে পড়েন নি। মহাভারতে যুধিষ্ঠির রামায়ণের গল্প শোনেন, তাঁর চরিত্রে আমূল পরিবর্তন হয়। তিনি রামকে নিজের আদর্শ মেনে আদর্শ ক্ষত্রিয় হতে চেষ্টা করে গেলেন আজীবন।
এইভাবে রামায়ণ সংস্কৃতিকে ভারতের বিভিন্ন অংশে নিজের মতন করে বিবর্তিত হওয়ার রাস্তা শুরুতেই করে দেওয়া হয়েছিল এবং এটি হিন্দু পৌরাণিক ধরার একটি বিশেষত্ব। বিভিন্ন আঞ্চলিক রামায়ণ ও রামের পূজিত দেবতা হয়ে ওঠার কাহিনী ও বাংলাদেশে রামায়ণ সংস্কৃতির খুঁটিনাটি থাকছে পরবর্তী পর্বে।
Discussion about this post