একের পর ট্রেন ফিরছে, এক চরম আনন্দ মাখা চোখে মুখে পরিযায়ী শ্রমিকদের ঢল নামছে। বাড়ি ফিরে পরের দিনই সেই ঢল পরিবারের সঙ্গে এলাকার বাজারগুলোতে আছড়ে পড়ছে। খুশির ঈদে প্রতিবার এটাই মালদার চির পরিচিত ছবি। গতবারের ঈদে ক্ষতিগ্রস্ত বস্ত্র ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সিমাই, আতর, জুতো ব্যবসায়ীরা এ বছরের ঈদে ব্যবসা হবে ভেবে আশায় বুক বাঁধছিল। ঠিক সেই সময়ে খাড়ার উপর আঘাতের মতো নেমে আসলো ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ।
জেলাটি একদিকে মুর্শিদাবাদ এবং ঝাড়খন্ড, আরেকদিকে দুই দিনাজপুর ও বিহারের প্রান্তিক সীমান্ত লাগোয়া হওয়ায় প্রতি বছর এখানে ঈদে প্রচুর ব্যবসা হয়। সবচেয়ে বেশি ভিড় উপচে পড়ে জেলার কেন্দ্রবিন্দু তথা মালদা সদর তথা ইংলিশবাজার ও কালিয়াচকে। ঈদের সময় এখানকার বস্ত্র থেকে জুতোর বড়ো বড়ো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলি প্রতিদিন লাখ টাকার ব্যবসা করে। বাজারে জায়গা থাকেনা পা ফেলার আর দোকানের কর্মচারীদের পান না স্বস্তির নিঃশ্বাস নেওয়ার সামান্য অবসর। বস্ত্র ও জুতোর বাজারে মানুষের ভিড় বুঝিয়ে দেই ব্যবসা প্রথম দিকে কার্যত কিছুটা ভাঁটার মধ্যে গেলেও এখনকার শেষ বাজারের হিসেবে লোকসান একদমই নেই। পা ফেলতে না পারার মতো বড় জনসমাগম না হলেও ভিড় রয়েছে। মানুষের মাঝে সামাজিক দূরত্ব, করোনা আতঙ্ক, আর কিছুটা আছে বেহাল সময়ের অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের গভীর ছাপ। সবকিছুর মধ্যেও সাবধানতা আর সরকারি স্বাস্থ্য বিধি মেনেই জেলার মানুষ ঈদের খুশি কিছুটা ভাগ করে নিতে চাইছে।
বাজারের অবস্থা আরও ভালোভাবে বুঝতে আমরা সরাসরি পৌছে গিয়েছিলাম মালদা শহরের প্রতিবছরের মোটা টাকার ব্যবসা করা এক বস্ত্র প্রতিষ্ঠানে। সেখানে ম্যানেজার থেকে কর্মচারীদের সঙ্গে কথা বলে বোঝা গেল ২০২০ সালের আগের বছরগুলোর তুলনায় কম কেনাকাটা হলেও খুব একটা খারাপ পরিস্থিতি নয়। আরও জানা গেল এ বছর ভিড় কম হলেও সেই জায়গায় দায়িত্ব বেড়েছে দোকানীদের। ক্রেতাদের কাছে তাদের পছন্দের সামগ্রী পরিবেশন করা, সঙ্গে রয়েছে হাত স্যানিটাইজের ব্যাপারটাও। তাছাড়া সকাল থেকে বাজার খোলা থাকলেও সাময়িক লকডাউনের নিয়ম হিসেবে দুপুরের মূল বিকিকিনির সময়েই দোকান বন্ধ রাখতে হচ্ছে। ঈদের কেনাকাটা করতে মাস্ক পরিহিত মানুষকে দেখা গেলো শহরের ব্যস্ততম চিত্তরঞ্জন মার্কেটের দোকানগুলোতেও। প্রতিবছর বড় ব্যবসা করা নামজাদা জুতোর ব্র্যান্ডের দোকানে চলছে ভালোই কেনাকাটা।
জেলার বাকি শহরের হালচাল বুঝতে আমরা চলে এসেছিলাম কালিয়াচকে। এখানে ঈদে বস্ত্র, জুতো, আতর থেকে সিমাই প্রত্যেকটা জিনিসের কেনাকাটাতেই এক অভূতপূর্ব ব্যবসার সাক্ষী থাকে। কিছু দোকানদারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, সাধারণ মানুষের ব্যবসা-বানিজ্য থেকে কাজকর্ম ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় মানুষের পকেটে অনেকটাই টান রয়েছে। কালিয়াচকের পাশের গ্রামগুলো থেকে প্রতি বছর পরিযায়ী শ্রমিকের কাজ করতে বহু সংখ্যক মানুষ ভিন রাজ্যে যায়। সারা বছর টাকা উপার্জন করে এই ঈদের সময় বাড়ি ফেরে ও পরিবার সহ ঈদের বাজার করে। কিন্তু গত বছর কাজ হারানো ও তার সঙ্গে পুনরায় কর্মস্থলে ফিরে মোটা টাকা উপার্জনের আগেই ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ আছড়ে পড়েছে। ফলে মোটের ওপর ব্যবসা মোটামুটি হলেও লকডাউনে তৈরি হওয়া ঘাটতি কাটিয়ে ওঠা সম্ভব হবে না। জমজমাট ঈদের বাজারে দেখা গেল জাতীয় সড়কের পাশেই পসরা সাজিয়ে বিক্রি হচ্ছে সিমাই।
প্রায় একই রকম পরিস্থিতি এই জেলারই অন্যতম শহর চাঁচলে। সারাবছর পূজো আর ঈদ এই দুটো উৎসবের আশায় থাকে এলাকার ছোট ব্যবসায়ীরা। ঈদের বাজার অনেকটাই পড়েছে আংশিক লকডাউনে। ব্যবসা কেমন হচ্ছে জিজ্ঞাসা করা হল স্থানীয় কাপড় বিক্রেতা গৌতম বাবুকে। তিনি জানালেন গত বছর সম্পূর্ণ লকডাউনের সময় বাজারের যা হাল ছিল তার পরিবর্তন হয়নি। গত বছরের তুলনায় এইবছর মালের যোগান থাকলেও পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে। বাধ্য হয়েই তাঁকে কম লাভে বিক্রি করতে হচ্ছে কাপড়। ঈদের আগের পাঁচ দিন থাকে ব্যবসার জন্য ব্যস্ততম সময়। কিন্তু গত দু’দিন বৃষ্টির জেরে বিক্রি তেমন হয়নি। এক ক্রেতার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল সামগ্রীর দাম আগের চেয়ে বেড়েছে।
ঈদ ঈদ ঈদ খুশির ঈদ এসেছে”, ফুটপাথে লাউডস্পিকারে গান বাজছে। হংকং মার্কেটে কাপড় থেকে কসমেটিক, প্রত্যেকটা দোকানেই তখন চলছে তুমুল কেনাকাটা। আমাদের নজরে আসল শহরের একটি বড় আতর বিক্রির দোকান। যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিভিন্ন রকম দৃষ্টি নন্দন স্প্রে বোতলের আতরও চোখে পড়লো। হরেক রকম বাহারি সুগন্ধীর ভ্যারাইটি। বিকেল গড়িয়ে তখন সন্ধ্যা নেমেছে। ইফতারও হয়েছে সবেমাত্র। দোকানের মালিক শীস মোহাম্মদের সঙ্গে গল্পচ্ছলে দীর্ঘক্ষণ কথা হল। জানতে পারলাম এ বছর ব্যবসা খুবই খারাপ চলছে। বিক্রি নেই তাই বড় অর্ডারও তেমনভাবে আসেনি। এমনকি করোনার প্রকোপে সরকারিভাবে যানবাহন ও লোকাল ট্রেন বন্ধ। তাছাড়া সাময়িক লকডাউনে ব্যবসার সময় বেধে দেওয়ায় বীরভূম, ঝাড়খন্ডের মতো এলাকার ব্যবসায়ীরা এখানে আসতে পারছেনা। তাই এ বছর বাকি বাজার মোটের উপর ভালো হলেও আতরের ব্যবসা কার্যত ক্ষতির মুখেই।
বাজারে ভিড় তখন থিতিয়ে আসছিলো। সরকারি বিধিতে সাময়িক লকডাউনে আর কিছুক্ষণের মধ্যেই সব দোকানপাট বন্ধ করতে হবে। উৎসবের মেজাজে মাতোয়ারা শহরে আলোকসজ্জার ঝলকানি ফের জানান দিচ্ছে খুশির ঈদ এসেছে।
প্রতিবেদন ও চিত্র ঋণ – শাইন জাহেদি এবং মহঃ মুস্তাকিম, চিত্র ঋণ – সুমন রায় চৌধুরী
Discussion about this post