জীবন
বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত
একটি ঘোড়ার জন্য বসে থেকে থেকে
একটি পুরুষ ঘোড়া বুড়ো হয়ে যায়। সূর্য
ভেঙে গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে
শেষে আকাশের গায়ে মুছে গেলে
পুরুষ ঘোড়াটি
পুরোনো দিনের কথা ভাবে,
যখন বয়স ছিল তার। যখন বিচুলি, ঘাস
বস্তা বস্তা ছোলা খেয়ে দৌড় শুরু হতো
আর সেই দেখে হেসে ঠেস দিয়ে
যুবতী ঘোড়ারা ঢলে যেতো একে একে
নিজেরাই নিজেদের গায়ে।
রাত্রি আরো
ঘন হলে পেয়ারা বাগানে
গাঢ় ও গহন শীত নামে। বুড়ো ঘোড়া জানলার পাট খুলে
ঘরের ভেতর উঁকি মারে, দ্যাখে
তার মাদী ঘোড়া কাদা হয়ে গ্যাছে
কাল ঘুমে।
জীবন শুধুই কাদা কাদা—এই বলে
বুড়ো ঘোড়া আকাশে চাঁদের দিকে ছোটে।
আপনি সততই সঠিক, “জীবন শুধুই কাদা কাদা–” আর সেই কাদা ভরা জীবনে আমাদের কাল ঘুম থেকে না জাগিয়েই আপনি চলে গেলেন চাঁদের দেশে। সত্যিই তো, যেদিন বস্তা বস্তা ছোলা আর ঘাস, বিচুলি খেয়ে নতুন দিগন্তের পথে দৌড়তেন, সেদিন যুবতী-সমাজ ঢলেই পড়তো নিজেদের গায়ে। রোমাঞ্চিত হয়ে উঠত, নতুন সমাজের ভাবনায়। কিন্তু আপনার হঠাৎ করে এইভাবে চাঁদের দেশে চলে যাওয়াটা কোনো ভাবেই মেনে নিতে পারছি না। আপনি শুধু বাংলা তথা ভারতবর্ষের অন্যতম চলচ্চিত্রকারই নন, আপনি তো এক ‘নতুন ভোরের যোদ্ধা’।
প্রচার বহুল চাকচিক্যপুর্ন সিনেমা থেকে বহু দূরে, অনাড়ম্বরভাবে, অগণিত নাম না জানা মানুষের কথাকে কবিতা, গল্প আর রূপোলি পর্দায় আলো দিয়ে এঁকে গেছেন আপনি। বারংবার আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়েছেন সমাজের অসম লড়াইয়ের চিত্র। সাম্যবাদে বিশ্বাসী মানুষ আপনি, সমাজকে একটা সার্চ লাইটের তলায় আনতে আজন্ম প্রতিবদ্ধ থেকেছেন আর নিজেকে চিরকাল সার্চ লাইটের থেকে দূরেই রাখতে ভালোবেসেছেন। স্বাধীনতা প্রাক্কালে জন্মজাত, রাঢ় বাংলার লাজুক, শান্ত স্বভাবের কিশোর, আপনি সেদিন পুরুলিয়া থেকে হাওড়ায় দীনবন্ধু হাইস্কুলে পড়তে এসেছিলেন। তখন কি জানতেন, যে আপনিই একদিন কালজয়ী সিনেমায় ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র জগতের এক নতুন দিক উন্মোচন করবেন! হয়ত না। বাবার চাকরি সুত্রে বাংলা পেরিয়ে সুদূর তৎকালীন মধ্যপ্রদেশের, মনেন্দ্রগড়েও শৈশব কাটিয়েছেন আপনি। পুরুলিয়ার উপজাতি আর মধ্যপ্রদেশের উপজাতিদের সংস্পর্শে জ্ঞানের বিকাশ ঘটেছে আপনার।
পরবর্তী জীবনে স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক হয়ে, পরে বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক আপনি, ভারতবর্ষের ভগ্ন আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে চোখে আঙুল দিয়ে সমাজের মানুষের কাছে পৌছে দেওয়ার জন্য গল্প, কবিতার পাশাপাশি বেছে নেন সিনেমাকে। প্রথম ১০ মিনিটের এক স্বল্প-দৈর্ঘের ছবি ‘দ্য কন্টিনেন্ট অফ লাভ’ তৈরি করে সিনেমা জগতে পা রাখেন। কিন্তু সিনেমার খিদে আপনাকে তাড়িয়ে বেড়ায়। ব্যক্তিগত সম্পর্কের লড়াইয়ের পাশাপাশি সমাজের বৃহত্তর লড়াইযের গল্পকে ১৯৭৮ সালে চিত্রায়ন করেন ‘দূরত্ব’ ছবিতে। আর আপনার জীবনের এই প্রথম ছবি দিয়ে আঁকা সমাজের কঠিন বাস্তব কবিতাই ছিনিয়ে আনে জাতীয় পুরস্কার।
সমাজবাদী ভাবনায় ভাবিত আপনি ১৯৮২ সালে তৈরি করেন ‘গৃহযুদ্ধ’। সুধী সমাজকে ভাবতে বাধ্য করেন অসম সমাজের কঠিন লড়াইয়ের ভয়ানক চিত্র সম্পর্কে। ভেনিস ফিল্ম ফেস্টিভালে সেই ছবিটি মনোনয়নও পায়। তারপর ‘বাঘ বাহাদুর’, “চরাচর”, ‘লাল দরজা’, ‘মন্দ মেয়ের উপাখ্যান’ আর ‘কালপুরুষ’- পরপর পাঁচটি ছবিতে জাতীয় পুরস্কার, আর সারা পৃথিবী থেকে সন্মান কুড়িয়ে আনা। আপনি সেই সমাজবাদী চলচ্চিত্রকার, যিনি সর্বদাই প্রচারের আলোর বাইরে থেকে গেছেন, আর আপনাকে নিয়ে গত চল্লিশ বছরে তেমন কোন হৈচৈও করে নি কেউ। আপনি অসম গৃহযুদ্ধটা চালিয়েই গেছেন যুগ যুগ ধরে। আপনি তো রাজার কাহিনী লেখেন নি, তাই আপনাকে ধন্য ধন্য করবে কে?
কোনো সময় এক সাক্ষাত্কারে আপনি বলেছিলেন, “আমার মনে হয়েছে যে, সবকিছুতেই একটা ট্র্যাডিশন তৈরি হয়। জীবনযাপনের ক্ষেত্রে যেমন হয়, শিল্পচর্চার দিক থেকেও হয়। আমাদের সমস্যা হচ্ছে, ওই ট্র্যাডিশনটাকে বিশ্বাস করে ফেলা। ক্রিয়েটিভ জায়গাতেও তাই মনে হচ্ছিল। ওই যে ট্র্যাডিশন, তার মধ্যে ঢুকে পড়লে ঠিকঠাক হবে, কেননা, তার বাইরে কাজ করলে অনেক সমস্যা আছে। দর্শক বুঝবে না, প্রযোজকও পাবে না। ফলে অনেক সমস্যা। তাই নতুন কিছু করতে গেলে সাহসের দরকার লাগে।” আপনি সেই অসম সাহসী কোনোদিন প্রযোজক বা দর্শকের তোয়াক্কা করেন নি। এঁকে গিয়েছেন শ্রেণীবদ্ধ, সমস্যাপূর্ণ, কঠিন আর্থ-সামাজিক অবস্থার কালজয়ী কাহিনীর ছবি।
হে গুণী, আপনার গৃহযুদ্ধ আজও চলছে। তাকে থামাতে পারিনি আমরা। সমাজকে ভাবাতে পারি নি, নিজেও ভাবিত হতে পারিনি। প্রেক্ষাপট হয়ত বদলেছে, কিন্তু কাহিনী বদলায়নি। ঋত্বিক ঘটক, সত্যজিৎ রায়, মৃণাল সেনের পরে আপনার চলে যাওয়াতে বাংলা তথা ভারতবর্ষের চলচ্চিত্র জগৎ আরও একটি বার পিতৃ হীন হল। শুধু তাই নয়, আজ আপনি ছাড়া সমাজ ফের এক অসম গৃহযুদ্ধের সন্মুখীন হয়ে গেল। কারন অগণিত সাধারন মানুষের কথা বলার রূপকারই রইল না। কিন্তু আমরা থামব না, অবশ্যই চেষ্টা করবো আপনার দেখানো রাস্তায়, নতুন ভোরের পথে হাঁটতে।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – https://alchetron.com/
Discussion about this post