“জানি সে কোথায়, এই শহরের কোনো বাগানে সে হয়ে আছে ফুল/ প্রতি সন্ধ্যায় পাঁপড়ি মেলে দিয়ে সে আবার ভোরে ঝরা বকুল’’- ফুল তো সন্ধ্যাবেলা আলো ফুরোতেই ঝিমিয়ে যায়। তবে এ কোন ফুলের কথা বলা হচ্ছে? বলা হচ্ছে সেইসব ফুলের কথা, সেইসব মেয়েদের কথা, যাদের রাত্রি বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভোরের বকুলের মতই সেজে উঠতে হয়। সেই সব ফুলের কথা আমরা অনেকে জানি, অনেকে জানিনা। কে কোথায় কখন ফুল হয়ে ঝরে যাচ্ছে, বা কীভাবে ফুল হয়ে ফুটে উঠতে চাইছে, তার খবর জেনেও জানিনা বলেই হয়ত অভিমানী ফুলের দলেরা হারিয়ে যায়। বাংলাদেশের দৌলতদিয়ার যৌনকর্মীরা যেভাবে যুগের পর যুগ ধরে হারিয়ে গেছেন।
দৌলতদিয়ার যৌনপল্লিটি বাংলাদেশের সরকারী লাইসেন্সধারী যৌনপল্লির মধ্যে একটি। দেশের তো বটেই, এমনকি দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম বৃহত্তম যৌনপল্লীও এটিই। ১৯৮৮ সালে এই যৌনপল্লী গড়ে উঠলেও তার বহুকাল আগে থেকেই এই অঞ্চলে পতিতাবৃত্তির সঙ্গে জড়িত মানুষ বসবাস করতেন। যমুনা ও পদ্মার মিলনস্থল হিসেবে দৌলতদিয়া বিখ্যাত ছিল ফেরিঘাটের জন্য। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পণ্যবাহী ট্রাক পার হতো ফেরিঘাট দিয়ে। ফেরি পার হতে কখনও অপেক্ষা করতে হতো দিনের পর দিন। সেই সময়েই মনোরঞ্জনের জন্য নারীদেহের চাহিদা ছিল। যৌনপল্লী গড়ে উঠতে বেশী সময় লাগেনি। বর্তমানে এটি প্রায় একটি ছোট শহরের আকারে গড়ে ওঠা অঞ্চল।
এখানে খদ্দের আর যৌনকর্মীদের প্রয়োজনীয় সব কিছুই পাওয়া যায় হাতের কাছে। বিউটি পার্লার, মার্কেট, জুয়ার আসর থেকে শুরু করে খদ্দেরের মনোরঞ্জনের সমস্ত উপকরণ থাকলেও যৌনকর্মীদের মানসিক স্বাস্থ্য, এবং বাহ্যিক স্বাস্থের খোঁজ রাখা হয়না সেইভাবে। কিছু যৌনকর্মী প্রায় তিন প্রজন্ম ধরে কাজ করছেন। এমনকি রয়েছেন ব্রিটিশ আমলের যৌনকর্মীর বংশধরও। রাত বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বাড়লেও কোন যৌনকর্মী মারা গেলে তার মরদেহটিকেও সৎকার করতে কেউ এগিয়ে আসতেন না। এই পল্লীতে জন্মানো বা দালালের মাধ্যমে পাচার হওয়া নব্বই শতাংশ বালিকা বা কিশোরীদের শরীরে প্রয়োগ করা হয় স্টেরয়েড, যাতে কম বয়সেই তাদের ‘কাজে লাগানো’ যায়। জন্মানো সন্তানকেও তাই একরকম ‘গোদের উপর বিষফোঁড়া’ বলেই মনে করেন কর্মীরা।
বাংলাদেশে বিগত বছরে মাদারীপুর, খুলনা এবং টাঙ্গাইল সহ বেশ কিছু অঞ্চলে যৌনপল্লি উচ্ছেদ হয়েছে৷ সামাজিকতা, ধর্ম, সংস্কার সমস্তকিছুকেই উচ্ছেদের কারণ হিসেবে দেখানো হয়েছে। কিন্তু এক অঞ্চলে উচ্ছেদের সঙ্গে সঙ্গে ভিড় বেড়েছে অন্য অঞ্চলে। অবনতি হয়েছে যৌনকর্মীদের। বাংলাদেশে ‘গণিকাবৃত্তি’ অবৈধ নয়৷ প্রাপ্তবয়স্ক নারী স্বেচ্ছায় এই পেশা বেছে নিতে পারেন৷ কিন্তু, বাস্তবের সমাজে তা গৃহীত নয় এখনও। দৌলতদিয়া এবং বাংলাদেশের অন্যান্য যৌন পল্লীর কর্মীদের অবস্থা তাই ভালো নয় একেবারেই।
Discussion about this post