পাড়াগাঁয়ের অন্ধকার সন্ধ্যায় জ্বলতো হ্যারিকেনের ধিকিধিকি আলো। ঠিক তখন ঠাকুমার ঘর জুড়ে নামতো রূপকথা। চাটাই পেতে বসতো সেকালের ছোট বেলারা। পাঠশালাতেও ছেলেরা বসতো চাটাই পেতে। বাড়ি থেকে বয়ে আনতে হতো তা। লেগে থাকতো মা ঠাকুমার হাতের আদর। এখন সেসব দিন গেছে। পাঠশালা উঠে এসেছে কোচিং সেন্টার। হ্যারিকেন গিয়ে ইনভার্টার। গ্রাম্য আপ্যায়নেও এসেছে শহুরে কেদারার ঘটা। খেজুর পাতার চাটাই তাই তেমন বোনে না কেউ। পূর্ব মেদিনীপুরের কাঁথি। ধরে রাখে পুরনো যত সংস্কৃতি। এখনও সেখানে বোনা হয় চাটাই। ঘরে ঘরে সন্ধ্যা নামলে, উঠোনে যেন পাতা হয় চাটাইয়ের নস্টালজিয়া। কাঁথির পুকুর পাড়ে ঢুঁ মারলে এখনোও চোখে পড়ে, চাটাই পেতে বিশ্রাম নেওয়া ক্লান্ত মানুষ।
বড়ো অদ্ভুত এই চাটাইয়ের গঠন। মেয়েলি চুলের বিনুনির মতো খানিক। পাতার ভাঁজে পাতা রেখে আঁটোসাঁটো তার বুনোট। আগে মেদিনীপুরের যেকোনো গ্রামেই চাটাইয়ের বড়ো চাহিদা ছিল। এখন তা আর নেই। তবে কাঁথির গেরস্থালির বড়ো আদরের সে। কখনও সে পাতা থাকে, খাট বিছানার তলায়, লম্বা করে। কখনো দরজার কোনায় সযত্নে গোটানো। কখনও আবার খেতে বসার আসন হিসেবে সে অপরিহার্য। হাতে কলমে প্রশিক্ষণের প্রয়োজন হয় না এ ধরনের বুনোটে। লাগে শুধু হাত যশ। চাটাই বোনার পদ্ধতি ভীষণ আলাদা। খেজুর পাতা প্রথমে গাছ থেকে পেড়ে আনতে হবে। পাতায় জমা ধুলো ময়লা প্রথমে বর্ষার জলে ধুয়ে যেতে দিতে হবে। তারপর শরতের মেঘভাঙা রোদ্দুরে তাকে শুকোতে সময় দিতে হবে। শুকোতে শুকোতে শীত নেমে আসবে বাংলায়। ‘শিউলি’রা যখন খেজুরের রস পাড়তে গাছে উঠবে! তখন তাদের দিয়ে পাড়িয়ে, উঠোনে জমাতে হবে অনেক খেজুর পাতা। দুপুরের মিঠে রোদে বসে, ছুঁচ বা সেফটি পিন দিয়ে আলাদা করে নিতে হবে পাতার শিরদাঁড়া। এবার পান চিবোতে চিবোতে মন দিয়ে বুনলেই হয়ে যাবে আসন বা বড়ো চাটাই।
কাঁথিতে চাটাই বোনা পেশা হিসেবে নিয়েছে যাযাবরেরা। যাযাবর বললে ভুল হবে। তারা অনেকেই স্থায়ী বসতি গড়েছে মারিশদা বা খেজুরির দিকে। সাধারণত শবর উপজাতির মানুষ এরা। এদের মেয়েরা বোনে চাটাই। হাটে বিক্রি করে আনে উপার্জনের অন্য পথ। এদের বোনার পদ্ধতিও আলাদা। প্রায় তিন-চার ইঞ্চি চওড়া হয় এসব পাটি। লম্বায় আশি থেকে একশো ফুট। গোল করে পাকিয়ে রেখে দেওয়া হয়। হাটের সময় বা মেলার মরশুম এলে কেটে বিক্রি করা হয়। প্রয়োজন মতো ছ-সাত ফুট করে কেটে সেলাই করা হয় ধারগুলো। কেবল পাতার বাঁধনেই এ চাটাই তৈরী হয়। শবর মেয়েদের কাছে মেলে চার-পাঁচ ফুট চওড়া চাটাইও। মাথায় লম্বা চাটাইয়ের বোঝা নিয়ে চলতি মেয়েদের কেবল কাঁথির হাটেই দেখা যায়।
অনেকরকম হয় এ চাটাই। আসন, মাদুর গোছের আর ধাউরিয়া। ধাউরিয়া জাতীয় চাটাই, দৈর্ঘ্যে লম্বা প্রস্থে ছোট। গ্রামের নেমন্তন্ন বাড়িতে দেখা যায়। লম্বা করে মেলা থাকে এটি। এক লাইনে বসতে পারে অনেক লোক। এহেন খেজুর পাতার চাটাই শবর মেয়েদের কাছে কিনলে দাম কম হয়। আসন প্রতি তিরিশ টাকা। মাদুর চাটাই প্রতি তিনশো আর একটা ধাউরিয়া সাড়ে তিনশো টাকায় মিলবে। এখন ভালো মানের পাতার অভাবে ধুঁকছে চাটাই শিল্প। ধুঁকছে খদ্দেরের অভাবেও। তবে অনেকেই এখন ঘরদোর নান্দনিকতায় মুড়তে কাজে লাগান প্রাকৃতিক শিল্প। এই উপজাতিক শিল্পে তাঁরা যদি আগ্রহী হন একবার! শিল্পটা তবে অনেকদিন বাঁচে। বেঁচে থাকে গল্প শোনার সন্ধ্যা আর পাঠশালা।
Discussion about this post