ভোজনরসিক বলেই পরিচিত বাঙালির আরো একটি উপাধি হয়েছে, তা হল ভ্রমণপ্রিয়। সারাবছর নিজের আয়ের একটি অংশ বাঙালি বাঁচিয়ে রাখে রোজনামচার একঘেয়েমি কাটিয়ে বছরে অন্তত একবার একটু হাওয়া বদলের জন্য। আর বাঙালীদের কাছে বরাবরই প্রিয় ঘোরার জায়গাগুলির মধ্যে অন্যতম পাহাড়। পাহাড়ের কথায় বাঙালির মনে প্রথমেই আসে পাহাড়ি শহর দার্জিলিংয়ের কথা। ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের অন্যতম একটি শহর ও পর্যটন কেন্দ্র দার্জিলিং। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যে পরিপূর্ণ দার্জিলিং শহর শুধুই এপার বাংলা নয় ওপার বাংলার পর্যটকদের কাছেও সমান জনপ্রিয়। বাংলাদেশের ঢাকা, রাজশাহী, খুলনা, সহ গোটা বাংলাদেশের কাছেই প্রায় দার্জিলিং পরিচিত।
দার্জিলিং-হিমালয়ান রেল এই শহরকে সমতলের সঙ্গে যুক্ত করে। ভারতের যে অল্প কয়েকটি বাষ্পচালিত ইঞ্জিন এখনও কার্যকরী, তার মধ্যে কয়েকটি এই রেল জোনের অন্তর্গত। দার্জিলিংয়ের অন্যতম পর্যটন পয়েন্ট গুলির মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ পয়েন্ট গুলি হল পদ্মজা নাইডু হিমালয়ান জুলজিকাল পার্ক, লেবং রেস কোর্স, ঘুম বৌদ্ধ মনাস্ট্রি, দার্জিলিং জয় রাইড, জাপানি বুদ্ধ মন্দির, অবজার্ভেটরি হিল ইত্যাদি। তবে বিশ্বের তৃতীয় উচ্চতম পর্বতশৃঙ্গ কাঞ্চনজঙ্ঘার দৃশ্যপট এই শহরের আকর্ষণ গুলির মধ্যে অন্যতম। বছরের নানা সময়ে প্রচুর সংখ্যক বাংলাদেশী পর্যটক এখানে আসেন। বাংলাদেশের পর্যটকদের কথা মাথায় রেখে দুই দেশের মধ্যস্থতায় ঢাকা থেকে নিউ জলপাইগুড়ি মিতালী এক্সপ্রেস চালু করা হয়েছে। ঢাকা থেকে শুরু করে মিতালী এক্সপ্রেস চিলাহাটি ও হলদিবাড়ি হয়ে নিউ জলপাইগুড়ি পৌছঁয়। যার ফলে বাংলাদেশ থেকে দার্জিলিং ভ্রমণ অনেকটাই সহজ হয়ে উঠেছে।
নিউ জলপাইগুড়ি রেল স্টেশন থেকে গাড়ি পাওয়া যায় তেনজিং নোরগে বাসস্ট্যান্ড পর্যন্ত। বাসস্ট্যান্ড থেকে সরাসরি দার্জিলিং যাবার বিভিন্ন গাড়ির ব্যাবস্থা রয়েছে। প্রায় দেড়শ বছরেরও বেশী প্রাচীন এই শহরের সাথে জড়িয়ে ব্রিটিশ আমলের বহু ইতিহাস। ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনের সময় দার্জিলিং অঞ্চলের চা বাগানগুলিতেও অসহযোগ আন্দোলন ছড়িয়ে পড়ে। উনবিংশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ব্রিটিশদের হাত ধরে দার্জিলিংয়ে প্রচুর চা বাগান গড়ে ওঠে এবং চা উৎপাদকেরা কালো চায়ের সংকর উৎপাদন করতে শুরু করেন। তার ফলে এক উৎকৃষ্ট ধরণের চায়ের উদ্ভব ঘটে দার্জিলিংয়ে, যা ধীরে ধীরে আন্তার্জাতিক স্তরে সর্বাধিক জনপ্রিয় কালো চা গুলির মধ্যে অন্যতম আসন গ্রহণ করে।
জানা যায়, গ্রীষ্মকালে সমতলভূমির প্রচণ্ড দাবদাহ থেকে রক্ষা পাওয়ার উদ্দেশ্যে ব্রিটিশ আধিকারিকেরা দার্জিলিংয়ের মনোরম আবহাওয়ায় বসবাস শুরু করেন। আর্থার ক্যাম্পবেল ও রবার্ট নেপিয়ার প্রচেষ্টার ফলে ১৮৩৫ থেকে ১৮৪৯ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে পাহাড়ের ঢালে চাষাবাদ ও ব্যবসা বাণিজ্য শুরু হলে দার্জিলিংয়ের জনসংখ্যা শতগুণ বৃদ্ধি পায়। ১৮৬৪ খ্রিষ্টাব্দে দার্জিলিং শহরকে বেঙ্গল প্রেসিডেন্সের গ্রীষ্মকালীন রাজধানী রূপে আনুষ্ঠানিক ভাবে ঘোষণা করা হয়। দীর্ঘদিনের করোনা মহামারিকে কাটিয়ে আজ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক ছন্দে ফিরেছে পাহাড়। পর্যটন ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি হাসি ফুটেছে দুই বাংলার পর্যটকদের মুখেও।
চিত্র ঋণ – মেঘা মন্ডল
Discussion about this post