হাতে সময় একেবারে অল্প, তাড়াহুড়োর মধ্যেই চাল-ডাল-সব্জির মিশ্রণে মুহূর্তে কুকারে তৈরী এই সুষম খাদ্য। আবার ঘৃত সহযোগে সেই খাদ্যবস্তুই জগন্নাথ দেবের ভোগ প্রসাদ। রামকৃষ্ণ পরমহংসদেবের জীবনের শেষদিকে আহারাদি বন্ধ হয়ে গিয়েছিল প্রায় একেবারেই। কিন্তু প্রবল শারীরিক কষ্টের মধ্যেও তিনি শুধুই বায়না করতেন সামান্য খিচুড়ি খাবেন বলে। এই খিচুড়ির মায়াজালে আবদ্ধ ঈশ্বর থেকে মনুষ্য কূল। সুকুমার রায়ের ‘খিচুড়ি’ কবিতাটিকেই কী করে বাঙালি ভুলতে পারে! “হাঁস ছিল, সজারুও, (ব্যাকরণ মানি না),হয়ে গেল ‘হাঁসজারু’ কেমনে তা জানি না৷” তার প্রতিটি লাইন এক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক। কারণ ‘খিচুড়ি’ শব্দের অর্থ সেরকমই ইঙ্গিত দেয়। অভিধান বলছে এর অর্থ ‘বৈসাদৃশ্যময় উপকরণে তৈরি মিশ্র খাদ্য’। মানুষ সর্বত্র ‘সিমেট্রিকাল বিউটি’ খুঁজলেও খিচুড়ির বেলায় বৈসাদৃশ্য! তা সে হোক,’জগা-খিচুড়ি’র চলতি ভাষার অর্থ সে সর্বত্র প্রমাণ করে এসেছে অক্ষরে অক্ষরে।
প্রোটিন-কার্বোহাইড্রেট মিলমিশে সত্যিই এ যেন সহজলভ্য সুষম খাদ্য। আবার বাঙালির রোমান্টিক থুড়ি পেটুক মন একটু বৃষ্টি-বাদলা পেলেই কেমন ‘খিচুড়ি-ইলিশ’ নাম জপতে থাকে। তবে খিচুড়ির বয়স কিন্তু অনেক। মোগল সাম্রাজ্য স্থাপনেরও পূর্বে। ভূ-পর্যটক ইবন বতুতাও ভারতীয় উপমহাদেশে মুগ ডাল আর চাল সহযোগে এক ধরনের খাদ্যের উল্লেখ করেছেন। পরবর্তীতে মোগল সম্রাটরাও প্রেমে পড়ে যান খিচুড়ির। খিচুড়িকে আরও সুস্বাদু করবার জন্য রাজ হেঁশেলে এই রান্নায় যুক্ত হতে পেস্তা আর কিশমিশ। খিচুড়ি রান্নায় এই সংমিশ্রণের ধারা শুরু সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে যার নাম দেওয়া হয় ‘লাজিজাঁ’। এমনকি খিচুড়ির উল্লেখ মেলে মহাভারতে। আবার মনসামঙ্গল কাব্যেও উল্লেখ রয়েছে শিব ঠাকুর স্ত্রী পার্বতীর কাছে এই খিচুড়ির জন্য আবদার করতেন।
এই ‘ব্র্যান্ড ফুড ইন্ডিয়া’ খিচুড়ির চাহিদা যেন প্রবল হয় দুর্গাপুজোয়। মূলত অন্নভোগেই আয়োজন করা হয় খিচুড়ির। ভক্তদের মাঝে বিতরণও করা হয় সেই ভোগ প্রসাদ। বাড়ির হেঁশেলেও নবমীর জন্য বরাদ্দ এই রান্না। ভুনো খিচুড়ি থেকে পঞ্চরত্ন নানা নামে সেও বিভূষিত। থালার মাঝে খিচুড়ি আর চারধারে সাজানো লাবড়া,চাটনি,পাঁপড়। আহা! অমৃতের বুঝি এরকই স্বাদ। সেই খিচুড়িকে নিয়েই উৎসব। উৎসবের খিচুড়ি নাকি খিচুড়ির উৎসব! বাংলাদেশে ফরিদপুরে কিন্তু চলতি বছরেই টিচার্স ট্রেনিং ময়দানে আয়োজিত হয় খিচুড়ি উৎসব। তবে শরতে নয় বরং বসন্তে। অংশগ্রহণকারীরা ১৬ টি স্টলে সাজিয়েছিল হরেক রকমের খিচুড়ি সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ভর্তা আর আচার। খিচুড়িকে নিয়ে কী অভিনব আয়োজন! এই উদ্যোগকে সাধুবাদ জানাতে এমন উৎসবের বন্দোবস্ত করা যেতেই পারে এপারেও। আহা ভেবেই কেমন একটা লোভ লাগছে!
Discussion about this post