গ্রামবাংলা মানেই তার পরতে পরতে মিশে থাকা বেশ কিছু বৈশিষ্ট্য ও নিজস্বতা। আমাদের দেশে বেশিরভাগ গ্রামেরই বিশেষ কিছু নিজস্বতা গ্রামগুলিকে করে তুলেছে অনন্য। ঠিক তেমনই একটা গ্রাম হাওড়া জেলার উলুবেড়িয়ার দাদপুর, যা প্রসিদ্ধ গ্রামের শিল্পীদের হাতে তৈরি তানপুরার জন্য। জেলার বিভিন্ন হস্তশিল্প বা কুটির শিল্পের মধ্যে অন্যতম এই শিল্প। এই গ্রামের প্রতিটি বাড়িতেই প্রায় তৈরি হয় তানপুরা ও অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র। স্বর্গীয় তারাপদ হালদারের হাত ধরেই অখ্যাত এই গ্রাম দাদপুরে শুরু হয় বাদ্যযন্ত্র তৈরির শিল্প। বর্তমানে এই ব্যবসার হাল ধরেছেন তাঁর উত্তর পুরুষ। হাওড়ার তানপুরা গ্রামের নাম ছড়িয়ে পড়েছে দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বিদেশে।
গোটা পৃথিবীর সঙ্গীত জগতের সুর যে বাদ্যযন্ত্রগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে, সেসব যন্ত্র তৈরি করতে ব্যস্ত গ্রামবাসী। প্রত্যেকটি বাড়ির উঠোন এবং দাওয়া থেকে ভেসে আসবে অপরূপ সংগীতের সুরের মাধুর্য। তৈরি হয় আধুনিক ইলেকট্রিক সেতারও। বিগত প্রায় ৫০ বছর ধরে এই গ্রাম প্রসিদ্ধ সঙ্গীতের যন্ত্র তৈরির জন্য। এই সব তারযন্ত্র তৈরির লাউ আসে হাওড়ার উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত লাগোয়া উদয়নারায়নপুর ব্লকের জয়নগর ও পালিয়াড়া, এবং হুগলি জেলার পশপুর এবং রঞ্জপুর থেকে। দুই জেলার পাশাপাশি চারটি গ্রামে বড় লাউ চাষ হয়। কলকাতা থেকে আমদানি করা হয় কাঠ।
এরপর অন্তত আট দশ জন সুদক্ষ কারিগরের হাতের ছোঁয়ায় প্রায় একমাস লাগে একটা সেতার বা অন্যান্য বাদ্যযন্ত্র তৈরি করতে। এরমধ্যে সুরবাহারের ঝকমারির বিভিন্নতা তো রয়েছেই। এর কাজ আরও নিখুঁত। তাই সময়ও লাগে অন্যান্যের থেকে আরও বেশি। গ্রামে বংশ পরম্পরায় বহু মানুষ এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। দাদপুরে ৬-৮ টি কারখানা আছে। সব মিলিয়ে গ্রামের প্রায় ১০০-১৩০ টি পরিবার এই পেশার সঙ্গে যুক্ত। এই যন্ত্র শিল্পীদের হাতের জাদুতেই পশ্চিমবঙ্গের এই ছোট্ট গ্রামটি বিশ্বের দরবারে ভারতের মুখ অনেকটাই উজ্জ্বল করছে। এমনকি সুদূর জার্মানী,ফ্রান্স, ইটালি সহ আরও বিভিন্ন দেশ থেকে আগ্রহী মানুষজন আসেন এই গ্রামে বাদ্যযন্ত্র তৈরির কাজ নিজের চোখে দেখতে।
বাইরে থেকে দেখলে মনে হবে সাধারণ আর পাঁচটা গ্রামের মতই চারিদিক সবুজে ঘেরা শান্ত একটি গ্রাম। কিন্তু আরেকটু ভিতরে ঢুকে কান পাতলে হারিয়ে যেতে হয় সুরের মূর্ছনায়। এই গ্রামের নামডাক, যশ, খ্যাতি, প্রসিদ্ধি আছে বহির্বিশ্বে। গ্রামের নাম ‘বাদ্যযন্ত্রের গ্রাম’ না হয়ে যায়ই বা কোথায়? অপূর্ব এই গ্রামটিতে পা রাখলে সত্যিই যে কারোর মনে বিশেষ জায়গা করে নেবে বলা যায়। অত্যন্ত দক্ষ কারিগরদের হাতে তৈরি এইসব যন্ত্র ও বিশিষ্ট সংগীতশিল্পীদের মেলবন্ধনে রোজ কত হাজার হাজার হাততালির জোয়ার ওঠে নামজাদা প্রতিটি মঞ্চে!
Discussion about this post