আজকের দিনে ব্যান্ড বললে আমরা বুঝি বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্য সম্বলিত গানের দল। কিন্তু পরশুরামের ‘লম্বকর্ণ’ গল্পের কথা মনে পড়ে, মনে পড়ে লাটুবাবুর কেরোসিন ব্যান্ড? সেও এক ধরনের গানের দল বা বলা ভালো সুরের দল। এদেরকে সোজা বাংলায় বলে ব্যান্ড পার্টি। একটা সময় আভিজাত্যের পরিচয় ছিল এই ব্যান্ড পার্টি। দুর্গা পুজো থেকে শুরু করে বিয়েবাড়ি মায়ে বাচ্চার অন্নপ্রাশনেও ব্যান্ড পার্টির ডাক পড়ত। ‘জলসাঘর’ সিনেমায় যেমন দেখা যায় কীভাবে জলসার রেওয়াজ আস্তে আস্তে মুছে যাচ্ছে বাঙালিয়ানা থেকে অনেকটা সেইরকমই খাদের কিনারে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যান্ড পার্টি।
মহাত্মা গান্ধী রোড ধরে কলেজ স্ট্রিটের দিকে যেতে রাস্তার দুধারে চোখ রাখবেন। দেখতে পাবেন কাচের দেওয়ালের মধ্যে রাখা ঝলমলে কিন্তু বেশ পুরনো পোশাক, ট্রাম্পেট, স্যাক্সোফোন, ড্রাম, ব্যাগপাইপ আরো কত কী। সবকিছুর ওপরেই বয়সের ছাপ পড়েছে, বয়সের রেখা ফুটে উঠেছে এই সমস্ত দোকানের মালিক ও কর্মচারীদের ওপরও। এখনও ঝলমলে পোশাকে দেখা যায় এদের, তবে বাঙালির মধ্যে ব্যান্ড পার্টি জনপ্রিয়তা হারিয়েছে। বিহার বা উত্তরপ্রদেশ থেকে এসে এই বাজনদাররা এক সময় বাঙালির সভা আলো করে ছিল। হিন্দি গানের সুরে বাঙালি তখন মাতোয়ারা। আর ব্যান্ড পার্টি মানেই পুরনো হিন্দি গানের সুরে তাল মেলানো। দুর্গা পুজোর বিসর্জনে কলকাতা বা শহরতলির বাঙালিকে দীর্ঘদিন আমোদ দিয়েছেন এরা। অথচ কলকাতায় আজ এমন একটি ব্যান্ড পার্টিও পাওয়া মুশকিল যারা শুধু অনুষ্ঠানে বাজনা বাজিয়ে পেট চালাতে পারেন।
আজকাল বাঙালির বিয়েতে তো এদের দেখা যায় না বললেই চলে। বাঙালির পছন্দ বদলেছে, রুচির পরিবর্তন হয়েছে। পুরনো হিন্দি গানের সুরে আর মন ওঠে না। তাছাড়া অর্থাভাব সকলেরই। একটা গোটা দল ভাড়া করে আনার চাইতে পছন্দ মতো প্লে-লিস্ট মিউজিক সিস্টেমে ফেলে দিলেই তো ঝামেলা মিটে যায়, উল্টে একটি পয়সার খরচও নেই। এভাবেই মানুষের রুজি রোজগার ছিনিয়ে নিচ্ছে উন্নত প্রযুক্তি। সেই মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হয়ে আবার নেমে এলো কোভিড। যাও বা টিম টিম করে জ্বলছিল ব্যান্ড পার্টিগুলো কোভিডের আক্রমণের পর সেটুকুও ধুলিসাৎ হতে বসেছে। লকডাউনের বাজারে এদের রোজগার সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। তারপর এই সমস্ত বাজনদাররা শুধুমাত্র শিল্পের ওপর আস্থা রাখতে পারেননি। প্রত্যেকেই অন্য কাজ খুঁজে নিয়েছেন। কিছু না হোক দিনমজুরি করেও পেট চালাতে হচ্ছে পরিবারের।
তাও, বাপ দাদার হাতে ধরে শেখানো সুরের জাদু, সেকি একদিনেই ফোরায়! তাই আজও বিয়ের মরশুমে, পুজোর গন্ধে গন্ধে ফিরে আসে ব্যান্ড পার্টি। তারা ধুলো ঝেড়ে আবারও মাথায় দেয় রঙিন টুপি, পরনে ওঠে ঝলমলে পোশাক আর হাতে চলে আসে প্রিয়তম বাদ্যযন্ত্রটি। এখনো যদি কোথাও থেকে ট্রাম্পেটে বা স্যাক্সোফোনে পুরোনো হিন্দি গানের সুর ভেসে আসে দেখবেন হয়ত কোনো ব্যান্ড পার্টি হঠাৎই বরাত পেয়ে মহড়া দিয়ে নিচ্ছে।
Discussion about this post