২০০৭-০৮ সালের পর পৃথিবী জুড়ে সব থেকে বড় অর্থনৈতিক আঁধার নেমে এসেছে। করোনা ভাইরাসের আক্রমণের সামনে গোটা বিশ্বের অর্থনীতির চাকা স্তব্ধ। সারা ভারতে করোনা আটকাতে গত কয়েকদিন ধরে সম্পূর্ণ সামাজিক তথা অর্থনৈতিক লকডাউন চলছে। এর ফলে একদিকে যেমন সারা দেশ থমকে গেছে তেমনই চিন্তার ভাঁজ পড়েছে অসংগঠিত ক্ষেত্র ও পরিযায়ী শ্রমিকদের কপালে। এই লকডাউন পরবর্তী সময়ে রাষ্ট্র যে ভয়ঙ্কর অর্থনৈতিক সংকটের মুখে পড়বে তা নিয়ে বেশিরভাগ অর্থনীতিবিদরাই একমত।
চটকে মোড়া পরিকল্পনাবিহীন সিদ্ধান্ত নেওয়া বর্তমানে মোদী সরকারের ট্রেডমার্ক স্টাইল হয়ে দাঁড়িয়েছে। ঠিক যেমন হঠাৎ করে মানুষকে ব্যাঙ্কের লাইনে দাঁড় করিয়েছিলেন তেমনই বর্তমান লকডাউনের ফলে পরিযায়ী শ্রমিকরা আটকে পড়েছেন তাঁদের কাজের জায়গায়।
একটি বিখ্যাত দৈনিকে প্রকাশিত খবর অনুযায়ী, দিল্লীতে কর্মরত বিহারের পরিযায়ী শ্রমিক করণ কুমার সম্পূর্ণভাবে নির্ভরশীল ছিলেন তাঁর দৈনিক মজুরির উপর। লকডাউনের ফলে কাজ চলে যাওয়ায় তাঁর পক্ষে দৈনন্দিন খাওয়ার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। শুধু করণ কুমারই নন। তাঁর পাঁচ সন্তান, স্ত্রী এবং বৃদ্ধ মা-বাবা সহ পরিবারের ভবিষ্যৎ আজ প্রশ্নের সামনে। সরকার থেকে সাময়িক স্বস্তি হিসেবে বিনা মূল্যে রেশন দেওয়ার কথা বললেও সিদ্ধান্তের যে সম্পূর্ণ বাস্তবায়ন হয়নি তা স্পষ্ট। এছাড়াও লকডাউনের ফলে আটকে যাওয়া শ্রমিকরা বাড়ি ফিরতে পারছেন না। ফলে স্বাস্থ্যকর থাকার জায়গার অভাবে তাদের বেঁচে থাকাই দুষ্কর হয়ে উঠছে। বাড়ি ফেরার তাড়নায় কিলোমিটারের পর কিলোমিটার হেঁটে বাড়ি ফিরছেন।
আপাতত ২১ দিনের লকডাউন শেষে এবং আরও ১৬ দিনের লকডাউনের নতুন ইনিংস শুরু হতে চলেছে। লকডাউনের প্রথম ইনিংসেই অর্থনীতির ভয়াবহ সম্ভাব্য পরিণতির কথা গণমাধ্যম মারফৎ আমাদের হাতে এসেছে। দীর্ঘ সময়ের লকডাউনের ফলে বাজার যেমন একদিকে চাহিদা শূন্য, অন্যদিকে গরীব মানুষের হাতে টাকা নেই। কাজের জায়গাগুলিতে শ্রমিকদের মধ্যে ন্যূনতম এক মিটার দূরত্ব রেখে কাজ শুরু করার প্রয়োজন। যদিও তা বাস্তবে সম্ভব নয় এবং এই ভাবে কাজ শুরু করলেও রোজের মজুরির ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকা শ্রমিকরা যে দারিদ্রের সমুদ্রে ডুবে গেছেন সেখান থেকে তুলে আনা সম্ভব হবেনা।
এছাড়াও দীর্ঘদিন ধরে বন্ধ থাকার ফলে ক্ষুদ্র শিল্পগুলি প্রায় বন্ধের মুখে। ছোট ব্যবসায়ীদের যে বিপুল পরিমান অর্থনৈতিক ক্ষতি হয়েছে তাঁর থেকে বেরিয়ে আসার কোনও সম্ভাবনা নেই। বর্তমানে ভারতের ৯০ শতাংশের বেশি কর্মী অসংগঠিত ক্ষেত্র ও কৃষির সঙ্গে যুক্ত। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী সমগ্র এশিয়া জুড়ে মোট শ্রম সময় প্রায় ৭.২% কমবে। যার পরিণতিতে এই লকডাউনের পর ভারতের মত তৃতীয় বিশ্বের দেশে প্রায় ৪০ কোটি অসংগঠিত ক্ষেত্রে যুক্ত শ্রমিক তাঁদের কাজ হারাবেন। ভারতের মাত্র ৮% শ্রমিক সংগঠিত ক্ষেত্রের সাথে যুক্ত। তাই তাঁদের জন্য সঠিকভাবে শ্রম আইন লাগু হলেও অসংগঠিত ক্ষেত্র সবসময়ই অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। ২০০১-১১ সময়কালের রিপোর্ট অনুযায়ী বছরে প্রায় ৫-৬ মিলিয়ন আন্তঃরাজ্য পরিযায়ী শ্রমিক এবং ৫০-৬০ মিলিয়ন আন্তঃজেলা পরিযায়ী শ্রমিক বাসস্থান থেকে অন্যত্র কাজের সুত্রে যান। ফলে পরিকল্পনা বিহীন লকডাউনের ফলে এই বিপুল সংখ্যক মানুষ একদিকে কাজের জায়গায় আটকে পড়েছেন। অন্যদিকে দৈনিক মজুরি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় গোটা পরিবারের খাওয়ার জোগাড় করা কঠিন হয়ে পড়েছে। তাই এটা পরিষ্কার যে দীর্ঘ লকডাউনের ফলে গরীব মানুষ করোনা আক্রান্ত হয়ে মারা না গেলেও অবশ্যই না পেয়ে মারা যাবেন। অসংগঠিত ক্ষেত্রের শ্রমিকদের মহামারী থেকে উদ্ধার করতে এবং তাঁদের হাতে প্রয়োজনীয় টাকা ও গরম ভাত পৌঁছে দিতে প্রয়োজন সঠিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা। কিন্তু সরকারের হাতে কোন বাস্তবিক পরিকল্পনা নেই। ফলে এই অপদার্থতার কারণে যে বিপুল সংখ্যক মানুষ মারা যাবেন তাঁর দায় সরকারকেই নিতে হবে।
লেখকের মতামত একান্তই ব্যক্তিগত, এর সঙ্গে ‘ডেইলি নিউজ রিল’ গণমাধ্যমের সম্পাদকীয় নীতির কোনও সম্পর্ক নেই।
Discussion about this post