বাংলার অতি প্রাচীন হস্তশিল্পগুলির মধ্যে উল্লেখযোগ্য শঙ্খশিল্প। নানা ঐতিহাসিক তথ্য এবং পৌরাণিক গাথা এই শিল্পের প্রাচীনতার স্বাক্ষর বহন করে চলেছে। পুরাণে এই শঙ্খ সৃষ্টির পেছনে একটি মজার গল্প আছে। নারায়ণের একনিষ্ঠ ভক্ত তুলসীদেবীর স্বামী ছিলেন শঙ্খাসুর। শঙ্খাসুরের অত্যাচারে দেবতারা অতিষ্ঠ হয়ে উঠলে মহাদেব তাঁকে বধ করেন এবং সমুদ্রে ভাসিয়ে দেন তাঁর অস্থি বা হাড়। সেই হাড় থেকেই সৃষ্টি হয় শঙ্খের। এ তো নেহাতই গল্প। আসলে শঙ্খ যে একধরণের জলজ প্রাণীর আবরণ বা খোলস, এ কথা সকলেরই জানা।
মূলত: বাংলাদেশের প্রাচীন হস্তশিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম ছিল এই শঙ্খ শিল্প। ব্রিটিশ লেখক জেমস ওয়াইজের লেখা পড়ে জানা যায়, প্রায় ৯০০ বছর আগে, অবিভক্ত বাংলায় (অধুনা বাংলাদেশে) শাঁখার প্রচলন শুরু হয়। তবে ঐতিহাসিকদের মত অনুসারে প্রায় দু’হাজার বছর আগেই দক্ষিণ ভারতে শঙ্খশিল্পের উদ্ভব হয়। তামিলনাড়ুর প্রাচীন রাজধানী কোরকাই এবং কায়েলের ভগ্নস্তূপ থেকে এই শিল্পের প্রাচীন নিদর্শন পাওয়া গেছে। এখান থেকেই বল্লাল সেন শাঁখারিদের নিয়ে আসেন বাংলাদেশে। বল্লাল সেনের সময়ই অর্থাৎ ১২০০ শতকে অধুনা বাংলাদেশে স্বাধীনভাবে এই শিল্পের বিকাশ ঘটে। সেই সময় শাঁখারি সম্প্রদায় ঢাকার বিক্রমপুরে বসতি স্থাপন করেন। এরপর ১৭০০ শতকে মুঘলরা এই শাঁখারিদের জন্য বিশেষ অঞ্চল নির্ধারণ করে দিয়েছিলেন যা পরবর্তীতে শাঁখারি বাজার নামে পরিচিতি লাভ করে।
পশ্চিম বাংলার বাঁকুড়ার হাটগ্রাম এবং বিষ্ণুপুরে মল্ল রাজাদের সময় থেকে শঙ্খ শিল্পের বিকাশ হয়। এখন হাটগ্রামে প্রায় তিনশো জন শিল্পী আছেন। এখানকার শিল্পীরা শঙ্খের উপর নানা পৌরাণিক আখ্যান ও দেবদেবীর ছবি ফুটিয়ে নক্সা বানানোর কাজে বিশেষ পারদর্শী। বিষ্ণুপুরের প্রয়াত দুখিরাম ওস্তাদ তাঁর উদ্ভাবনী চিন্তার প্রয়োগে শঙ্খের খোলস দিয়ে আংটি, দুল, নেকলেস থেকে শুরু করে ধূপদানি, শোপিস, এমনকি কাটলারি পর্যন্ত তৈরির নিদর্শন রেখে গিয়েছেন।
এই শিল্পে ব্যবহৃত বিশেষ প্রজাতির শঙ্খ শ্রীলঙ্কার জাফনা এবং ভারতের মাদ্রাজের তিতপুরে পাওয়া যায়। শঙ্খের অলঙ্কার তৈরির জন্য যেসব প্রজাতির শঙ্খ ব্যাবহার করা হয়, সেগুলো হল তিতপুটি, ঝাঁজি, দোয়ানি, ধলা, তিতকৌড়ি, সুরতি, আলাবিলা ইত্যাদি। এদের মধ্যে তিতকৌড়ি শঙ্খ সর্বোৎকৃষ্ট এবং আলাবিলা সর্ব নিকৃষ্ট। তবে বর্তমানে শাঁখার মূল্য বৃদ্ধির কারণে এর চাহিদা কমে যাওয়ায় এবং শিল্পীরা বিকল্প কর্মসংস্থানের প্রতি উৎসাহী হওয়ার দরুন শঙ্খশিল্পের ভবিষ্যত নিয়ে যথেষ্ট অনিশ্চয়তা রয়ে গিয়েছে।
Discussion about this post