চারণকবি বৈদ্যনাথ বলেছেন, “জ্যোৎস্নাজরির ঝলমলি দিল রেশম শিল্পে তোমার ছেলে/ শঙ্খ, পেতল, কাঁসার বাসনে কত দূরদেশে আদর পেলে।” বাঁকুড়ার ঐতিহ্য, শিল্প নিয়ে যদি হাজার হাজার বই, কবিতা লেখা হয় তাহলেও হয়তো কম পড়বে। বাঁকুড়ার প্রাচীনতম শিল্পগুলির মধ্যে অন্যতম হল শঙ্খশিল্প। আর এই শিল্প জগতে অন্যতম জায়গা হল হাটগ্রাম। এই শিল্পের মধ্য দিয়েই গোটা বিশ্বের নজর কেড়েছে এই গ্রাম। শুধু শাঁখা নয়, শঙ্খ দিয়ে যে কতরকমের জিনিস তৈরি হতে পারে সেটা এখানে না এলে জানা যাবে না। বাজাবার শাঁখ তো বটেই, তাছাড়া ধুপদানি, কাজলদানি, চুলের ক্লিপ, শঙ্খ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের শো-পিস তৈরি করেন এখানকার শঙ্খ শিল্পীরা। রাজ্যের বেশিরভাগ শাঁখা ও শঙ্খজাত জিনিসের অধিকাংশের যোগান দেয় এই হাটগ্রাম।
হাটগ্রামে শঙ্খ শিল্পের ইতিহাস বেশ পুরনো। কেউ কেউ মনে করেন মল্ল রাজাদের সময়কাল থেকেই বিষ্ণুপুরের সাথে সাথে এই হাটগ্রামেও শঙ্খের নানান কাজ হতে শুরু করে। পরে চাহিদা বাড়তে শুরু করায় এখানে শঙ্খ শিল্প অন্যতম প্রধান শিল্পে পরিণত হয়। এই শিল্পের প্রধান কাঁচামাল শঙ্খের যোগান আসে তামিলনাডু থেকে। চেন্নাই থেকে কলকাতা হয়ে বিভিন্ন ধরণের শঙ্খ এখানে আসে। এই গ্রামে কোন কোন পরিবারের সকলেই এই কাজের সাথে যুক্ত। কারণ একা একা এই কাজ সম্ভব নয়। যেসব শঙ্খ আসে সেগুলিকে প্রথমেই ঝাড়াই বাছাই করে বিভিন্ন সাইজের শঙ্খগুলিকে আলাদা করে নেওয়া হয়। এরপর মেশিনে শঙ্খ কাটিং করার জন্য রয়েছেন অন্য শিল্পী। আবার পালিশ আর হাতে পরার শাঁখার নকশা তোলার জন্য থাকেন আলাদা শিল্পী।
এখানকার বেশিরভাগ শিল্পী সাধারণত মহিলাদের হাতে পরার শাঁখা তৈরি করেন। কয়েক জন রয়েছেন যারা শঙ্খ দিয়ে বিভিন্ন শো পিস, ঘর সাজাবার জিনিস, ধূপদানি, কাজলদানি, মাথার ক্লিপ, কানের দুল বা গলার হার তৈরি করেন। এরা বংশ পরম্পরায় এই কাজ করে আসছেন। কিন্তু এই হাটগ্রামে এমন কয়েকজন শিল্পী রয়েছেন যাদের হাতে জাদু রয়েছে। অসীম দক্ষতা আর নিপুণতার সঙ্গে তারা শঙ্খের ওপরে হিন্দু পুরাণের নানান দেবদেবী বা রামায়ণ-মহাভারতের নানান ঘটনাবলীর নিখুঁত ছবি। এই একটি কাজ করতে একজন শিল্পীর প্রায় দেড়-দুই মাস সময় লাগে।
এই প্রসঙ্গে যাঁর কথা না বললেই নয় তিনি হলেন বিখ্যাত শঙ্খ শিল্পী বাবলু নন্দী। যাঁর জন্যই হাটগ্রামের নাম আজ জাতীয় স্তরে পৌঁছে গিয়েছে। আয়তনে বড় জোর ১১ইঞ্চি। ১১ ইঞ্চির শঙ্খের ওপর তিনি অত্যন্ত নিপুণতার সঙ্গে ফুটিয়ে তোলেন মহাভারতের আস্ত এক গল্প। কুরুক্ষেত্র যুদ্ধের দৃশ্যও যেখানে বাদ পড়েনি। কৃষ্ণ-অর্জুনের রথযাত্রা, কর্ণের রথের চাকার মেদিনীগ্রাস থেকে শুরু করে কৃষ্ণের বিশ্বরূপ দর্শন। অশ্বত্থামা বধ, ভীম-দুর্যোধনের গদাযুদ্ধ— সবকিছুই নিপুণ দক্ষতায় খোদাই করেছেন তিনি। স্নাতক পাশ করার পরেও তিনি শাঁখের ওপর শিল্পকলা ফুটিয়ে তোলাকেই জীবিকা হিসাবে বেছে নেন। অন্যান্য শিল্পীদের থেকে তাঁর কাজ পুরোটাই আলাদা। তাঁর কাজই তাঁর নিজের কণ্ঠ। একাধিক রাজ্য স্তরে পুরস্কারও পেয়েছেন তিনি। আধুনিকতার ছোঁয়ায় বাঙালি মহিলাদের শাঁখা পরার চল কমে গেছে। তাতে হয়ত চাহিদায় একটু ভাঁটা পড়েছে। তাই অনেকেই এখন শাঁখা তৈরি ছেড়ে ঘর সাজাবার অন্যান্য জিনিস তৈরিতে মন দিয়েছেন। এভাবেই বাঙালীর মধ্যে বেঁচে থাকুক হাটগ্রামের শঙ্খ শিল্প। সঙ্গে বেঁচে থাকুক হাটগ্রামের শঙ্খ শিল্পীরা।
Discussion about this post