মিষ্টি প্রিয় বাঙালির কাছে মিষ্টি এক অনন্য আবেগ আর আর তার থেকেও বড় আবেগ হলো বাঙ্গালীর বাংলা ভাষা।। বাঙালির এই মিষ্টি নিয়ে গর্ব আর আবেগে একটা অন্যতম জায়গা করে নিয়েছে বউবাজারের ভীম চন্দ্র নাগ। অন্য কারোর কাছে এই নামের গুরুত্ব কতটা সেই নিয়ে প্রশ্ন চিহ্ন থাকলেও বাঙালির কাছে এই নাম টুকুই যথেষ্ট। মিষ্টি নিয়ে বাঙালির গর্বের অনেক নাম থাকলেও কেন হঠাৎ শুধু এই নাম! এটাই ভাবছেন তো? কারণ খাবার মিষ্টি আর মন শান্ত করা মিষ্টি ভাষা বাংলা এই দুয়ের মিলন রয়েছে এখানে। বহু দিন ধরেই বাঙালিয়ানার এই ঐতিহ্য বয়ে নিয়ে চলেছে ভীম চন্দ্র নাগ।
ভীম নাগের এই মিষ্টি দোকান যতটা তার মিষ্টির জন্য প্রসিদ্ধ ঠিক ততটাই প্রসিদ্ধ দোকানের দেওয়ালে টাঙানো একটি ঘড়ির জন্য। আর সেটাই হলো ঐতিহ্য, বাঙালির গর্ব। এখন প্রশ্ন হলো ঘড়ি তো সব দোকানেই আছে এতে গর্বের আর কি? কিন্তু তা যে আর পাঁচটা সাধারণ ঘড়ি নয়; দোকানের আসা প্রতিটা মানুষের চোখ টানে সেই দেওয়ালে রাখা ঘড়িটি। কারণ এ ঘড়ির ডায়াল সম্পূর্ণ বাংলা। আরও চমকে দেওয়ার মতো বিষয় হলো এটা খোদ বিদেশি কোম্পানি ‘কুক অ্যাণ্ড কেলভী’ র তৈরি করা। বিশ্বাস না হলে একবার ঘুরে আসুন না, হলফ করে বলছি চোখ ফেরাতে পারবেন না এতটাই মিষ্টি দেখতে ঘড়িটি। কীভাবে এই ঘড়ি দোকানে এলো সে প্রসঙ্গে রয়েছে এক গল্প। মিষ্টির দোকান তাই দোকানের সব জিনিসেই রয়েছে মিষ্টির ছোঁয়া। এ গল্পেও তার কমতি নেই।
একদিন এই ভীম নাগের মিষ্টি দোকানে মিষ্টি খেতে আসেন ‘কুক অ্যাণ্ড কেলভী’র বড়সাহেব। লোভনীয় জিভে জল আনা হরেক রকম মিষ্টি এমনিতেই বড় সাহেবকে অভিভূত করেছিল বটেই। আর যখন তিনি সেই সব অপূর্ব মিষ্টি খেলেন তখন তিনি বাকরুদ্ধ, যাকে বলে একেবারে মিষ্টির মায়াজালে জড়িয়ে পড়লেন। নাগ মশাই এর সাথে বিভিন্ন গল্প চলাকালীন তিনি প্রশ্ন করেন যে তাঁর এত বিখ্যাত আর এত লোভনীয় সুস্বাদু মিষ্টিতে ভরপুর দোকান কিন্তু সে দোকানে কোনো ঘড়ি নেই কেন? এরূপ যে কোনো এক প্রশ্নের সামনাসামনি হবেন যে ভীম নাগ মশাই তা আগে একদম বুঝতেই পারেন নি। তাই খানিক ইতস্তত হয়েই বলেন যে তাঁর দোকানের কর্মচারীরা তো ইংরেজি পড়তে পারেন না, সে কারণেই ঘড়ি তিনি রাখেন নি। সুস্বাদু মিষ্টি খেয়ে বড় সাহেব আপ্লুত আর আবেগী হয়ে পড়েন। তিনি কথা দেন যে সেই সমস্যার সমাধান তিনিই করে দেবেন।
যেমন কথা তেমন কাজ। কিছু দিনের মধ্যেই তিনি লন্ডনের যেখানে এই কোম্পানির ডায়াল ও কেস তৈরি হয় সেখানে নির্দেশ পাঠান যে সম্পূর্ণ বাংলায় একটি ডায়াল প্রস্তুত করতে হবে এবং তা যত দ্রুত সম্ভব। হঠাৎ এমন আদেশে সেই পেন্টাররাও খানিক হতবাক। আদেশ মতো সাহেবী পেন্টারের কাঁপা কাঁপা হাতে লেখা দিয়ে তৈরি হয় এই অপূর্ব ঘড়ি, যার সমস্ত ডায়াল তাই পুরো বাংলায়। আরও অবাক করা বিষয় হলো এর মাঝে লেখা ‘কুক অ্যাণ্ড কেলভী’ কোম্পানির নামটিও বাংলায়। নিচে লেখা ‘লন্ডন’ কথাটিও সম্পূর্ণ বাংলায়। বড় সাহেব সেটি ভেট করেন ভীম চন্দ্র নাগ মহাশয়কে, যা আজও এই দোকানে সগর্বে শোভা পাচ্ছে।
বিষয়টি এখন অনেকটাই সহজাত হলেও, স্বাধীনতার আগের সময় তা কিন্তু অতটাও সহজ ছিল না। কেন বাঙালির কাছে এই বউবাজারের ভীম চন্দ্র নাগের মিষ্টি দোকান গর্বের অন্য জায়গা তা নিশ্চয়ই আর বুঝিয়ে বলার প্রয়োজন নেই। আজও মিষ্টির প্রসিদ্ধির সঙ্গে বাংলা তথা বাংলা ভাষার ঐতিহ্যকে বয়ে নিয়ে যাচ্ছে এই দোকান। বাঙালির আবেগের অন্যতম বাহক হয়ে যুগের পর যুগ অতিক্রম করছে এই দোকান। আর দোকানের দেওয়ালে পরম আদরে সাজিয়ে রাখা বাংলা ঘড়ি আজও জানান দিচ্ছে সঠিক সময়।
চিত্র ঋণ – debjani’s kitchen
Discussion about this post