চুঁচুড়ার খড়ুয়া বাজার থেকে নেতাজি সুভাষ রোড ধরে সোজা ঘড়ির মোড় অবধি প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা জুড়ে অবস্থিত হুগলী জেলার বৃহত্তম পাইকারী ও খুচরো বাজার। এই এলাকা হুগলীর সদর চুঁচুড়ার অন্যতম প্রাণকেন্দ্রও বটে। ঘড়ির মোড় থেকে খড়ুয়াবাজারের দিকে আসতে কিছুটা গিয়েই বাঁ দিকে পড়বে একটি হলুদ রঙের বিশাল দরজা। এর ওপরে লেখা ‘দয়াময়ী কালী মন্দির’। চুঁচুড়া শহরের এই প্রাচীনতম মন্দির আঞ্চলিক মানুষের কাছে যে ভীষণভাবে গুরুত্বপূর্ণ তা এই মন্দিরে জনসমাগম দেখে সহজেই অনুমান করা যায়।
ষোড়শ শতকের শেষ ভাগে প্রায় গোটা হিন্দুস্তান ও বাংলায় শাসন কায়েম করেছেন বাদশাহ আকবর। যদিও এই সুবিশাল সাম্রাজ্যের দেখভাল করতে তিনি অনেকটাই নির্ভরশীল ছিলেন আঞ্চলিক জায়গীরদারদের ওপর। হুগলীও ছিল না ব্যতিক্রম।তবে তখন ‘হুগলী’ নামে এই অঞ্চলটি পরিচিত ছিল কিনা, সে নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে মতবিরোধ আছে। আকবরের রাজস্বসচিব টোডরমল এই অঞ্চলটির যাবতীয় শাসনভার সঁপেছিলেন এক আঞ্চলিক জায়গীরদার জিতেন রায়কে। জিতেন রায় ছিলেন মাতৃকা পূজারী ও শাক্তধর্মের একনিষ্ঠ অনুসারী। তিনি জায়গীর পাবার পর গড়ে তুললেন এই অঞ্চলের প্রাচীনতম কালী মন্দির যা বর্তমানে চুঁচুড়ার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত দয়াময়ী কালীবাড়ি নামেই সুপরিচিত।
বর্তমানে ভগ্নপ্রায় মন্দিরটির আমূল সংস্কার হয়েছে, ফলে তৎকালীন স্থাপত্যশৈলীর নিদর্শনগুলি কালের প্রভাবে মুছে গিয়েছে। তবে এটা বুঝতে অসুবিধা হয়না যে মন্দিরগুলির গঠনে রেখদেউল স্থাপত্য রীতির যথেষ্ট প্রভাব রয়েছে। মূল মন্দিরটি ভবতারিণী জগৎজননী কালীর, মূর্তির আকৃতি খুব একটা বড় নয়। মূর্তির উচ্চতা প্রায় পৌনে দুই হাত, কষ্টিপাথরে নির্মিত মাতৃকামুর্তির জিহ্বা ও গয়না অলঙ্কার দিয়ে গড়া। মূর্তিটি সেই সময়কার ভাস্কর্য শিল্পের নিদর্শন বহন করে। পূবদিকে অবস্থিত পশ্চিমমুখী কালী মন্দিরের উত্তরদিকে এক সারিতে তিনটি শিব মন্দির অবস্থিত। সবকটি মন্দিরেই নাটমন্দির অনুপস্থিত কিন্তু মন্দিরের সামনে রয়েছে সুবিশাল খোলা উঠোন।
মন্দিরে ঢোকার মুখে একটি মার্বেল ফলকে লেখা রয়েছে, “দয়াময়ী কালী মন্দির সেবাইত গোপালরাম পাঠক।” মন্দিরটি পরিচালনা করেন এইচইউএফ ট্রাস্ট বোর্ড। স্থানীয় মতে, এখানে দয়াময়ী রূপে অধিষ্ঠিত কালিকা অত্যন্ত জাগ্রত। দীপান্বিতা অমাবস্যা, কৌশিকী অমাবস্যা, নববর্ষে ভক্তদের ঢল থাকে চোখে পড়ার মতন। কথিত আছে, এই ভক্ত সমগমের মধ্যে একদিন উপস্থিত ছিলেন আকবরের সেনাপতি মানসিংহ স্বয়ং। তিনি মন্দির প্রতিষ্ঠার পরে রাজস্থান থেকে পুজো নিবেদন করতে এই মন্দিরে আসেন। এই মন্দিরের ভোগের চাহিদাও প্রচুর ও দূর দুরান্ত থেকে ভক্তরা ভোগ সংগ্রহ করতে মন্দিরে এসে হাজির হন। তাঁদের দৃঢ় বিশ্বাস, মায়ের ডাকেই তাঁরা মন্দিরে আসেন।
Discussion about this post