একটা সময় ছিল যখন ঘরে ঘরে মোবাইল ফোন তো দূরের বিষয় ল্যান্ড ফোনও সকলের ছিল না। কিন্তু একটা জিনিস মধ্যবিত্ত পরিবারের ড্রইং রুমে শোভা পেত- টেলিভিশন। ভারতবর্ষে এই বোকা বাক্সের আগমন ১৯৫৯-এ হলেও কলকাতায় এর আমদানি ঘটে ১৯৭৫-এ। সাকুল্যে তখন মোট দুটি চ্যানেল; ডিডি ন্যাশনাল আর ডিডি বাংলা। দুপুরবেলা বাড়ির মেয়ে বউরা ছায়াছবিতে মত্ত। কিন্তু ছোটদের কী হবে?
ছুটির দিনের একটা মোটামুটি প্রতিশব্দ ‘রোববার’। এই রবিবার টিভিতে থাকত বাড়ির খুদে সদস্যদের জন্য হরেক রকম আয়োজন। প্রথমে ডিডি ন্যাশনালে রবিবার দিন ‘ছুট্টি ছুট্টি’ নামে একটা প্রোগ্রাম হত। যেখানে ছোটদের জন্য বিশেষভাবে আয়োজিত হত গান, নাচ, নাটক ইত্যাদি। এখানে অংশগ্রহনও করত শুধুমাত্র ছোটোরাই। পরে ডিডি বাংলাতেও এরই অনুকরণে শুরু হয় ‘ছুটি ছুটি’। ‘ছুটি ছুটি’র সঞ্চালক থেকে শুরু করে অনুষ্ঠানের সকল সদস্যই কচিকাঁচা। রবিবার দিন বাড়ির খুদেরা ঘুমাবে তো একটু বেলা পর্যন্ত। তাই অনুষ্ঠান শুরু হত সকাল ১১:০৫ থেকে, বাংলাদেশের সময় ছিল ১১:৩৫। রবিবার যদি দেখা নাও হয় পুনঃপ্রচারের ব্যবস্থা ছিল বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার দুপুর তিনটে থেকে, পরের দিকে অবিশ্যি শুধু বৃহস্পতিবার।
কী হত না এই রবিবারের ‘ছুটি ছুটি’-র আসরে! গান, নাচ, নাটক, আবৃত্তি, গল্প পাঠ, ম্যাজিক, এমনকি একটা আস্ত সিনেমা পর্যন্ত দেখানো হত। ছুটির দিন, তাই বলে কি পড়াশোনা নেই! ‘ছুটি ছুটি’-তে খুব খুব সহজে অঙ্কের মাস্টারমশাই শিখিয়ে দিতেন শক্ত শক্ত সব অঙ্ক। যে অঙ্ক বইয়ের পাতায় দেখলেই মনে হতো ‘ইস্ কী নীরস’, সেইগুলোই এখানে মনে হত জলের মতো সহজ। শুধু কি অঙ্ক নাকি, ফিজিক্স-কেমিস্ট্রি কিছুই বাদ পড়ত না। সবই হাতে গরম আর খুব সহজ করে বোঝানো। আর একটা খুব মজার জিনিস হত এখানে যেটার সঙ্গে মিল পাওয়া যায় ‘আর্ট অ্যাটাক’ বা ‘ম্যাড’-এর। নানারকম মজার মজার হাতের কাজ শেখানো হতো। কখনো মাটি দিয়ে কিছু তৈরি করা আবার কখনো কাগজ দিয়ে। এই ‘ছুটি ছুটি’-র দৌলতে ছোটরা দেখেছে ‘গুপি গায়েন বাঘা বায়েন’, ‘সোনার কেল্লা’ আরো কত কী।
‘ছুটি ছুটি’-তে প্রায়ই একটা ছবি দেখানো হত—‘লাল কমল নীল কমল’। এটা ডিজনি হটস্টারের অ্যানিমেটেড লাল কমল নীল কমল নয়। সেই ছবি এখন তো আর দেখাই যায় না। সেই রক্ত মাংসের লাল কমল, নীল কমল, রাক্ষুসী সবাই কোথায় যেন হারিয়ে গেছে। এখন ছুটির দিনেও বাড়ির ছোট ছোট ছেলেমেয়েরা কাঁধে ব্যাগ নিয়ে পড়তে যায়। গরমের ছুটিতে পড়ার চাপ আরো বাড়ে, এই সময় সিলেবাস তো এগিয়ে রাখতে হবে। এছাড়া থাকে আঁকার ক্লাস, সুইমিং ক্লাস, মায়ে একটি খেলার ক্লাসও। রবিবার বাড়ির সবকটা খুদে মিলে যখন ‘ছুটি ছুটি’-তে ডুবে থাকত তখন বড়রা হাঁপ ছাড়ত। দুষ্টুগুলোর অমন শান্ত চেহারা এমনিতে খুবই বিরল। এবারেও প্রায় সব স্কুলেই গরমের ছুটি পড়ে গেছে। ছোটদের কাছে ছুটির থেকে ভালো উপহার আর কিছু হয় না। কিন্তু ফেলে আসা সেই হারানো দিন বড়দের আজও ভাবিয়ে তোলে। মনে প্রশ্ন আসে বারবার যে, গরমের ছুটির নস্টালজিয়ার মজা, সেই সারল্য মাখা জীবন আর টেলিভিশনের ‘ছুটি ছুটি’কে কি আদৌ ফিরে পাবে জেনারেশন ওয়াই?
Discussion about this post