ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী মিষ্টান্ন ছানামুখী এবারে পেয়ে গেলো ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্যের স্বীকৃতি। শতাব্দী প্রাচীন এই মিষ্টি বহু বছর ধরেই সারা বাংলাদেশের মানুষের রসনার এক অন্যতম উপাদান হয়ে রয়েছে। বগুড়ার দই, নাটোরের কাঁচাগোল্লা, নেত্রকোনার বালিশ মিষ্টি যেমন সেই জেলার ঐতিহ্য বহন করে; সেরকমই বাংলাদেশের দক্ষিণ পূর্বের ব্রাক্ষণবাড়িয়া জেলার ঐতিহ্য বহন করে এই ছানামুখী। পুরনো ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারেও ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি হিসাবে উল্লেখ আছে ছানামুখীর। জিভে জল আনা ছানামুখীর উৎপত্তি এই অঞ্চলেই। চর্তুভূজ আকারের ছানার ছোট ছোট টুকরোর ওপর জমাটবাঁধা চিনির প্রলেপ দেওয়া এই মিষ্টি রসনার সঙ্গেই মনের তৃপ্তি আনতেও যথেষ্ট।
কথিত আছে, মহাদেব পাঁড়ে নামের এক কারিগর এই মিষ্টির উদ্ভাবক ছিলেন। তিনি ছিলেন ভারতের কাশীধামের এক কারিগর। মহাদেব তার দাদা দুর্গা প্রসাদের সঙ্গে কলকাতায় এসে মিষ্টির দোকানে কাজ শুরু করেন। তবে, দুর্গার অকাল মৃত্যুর পর, মহাদেব সেখান থেকে বেরিয়ে আসেন এবং ঘুরতে ঘুরতে চলে যান অধুনা বাংলাদেশের ব্রাহ্মণবাড়িয়ায়। তখন সেখানে এসে তিনি পৌর এলাকার শিবরাম মোদকের দোকানে কাজ শুরু করেন। সেই দোকানেই মহাদেব তৈরি করেন ছানামুখী, যা মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই সারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় সাড়া ফেলে দেয়। তার দেখাদেখি, অন্য দোকানদাররাও ছানামুখী বানানো শুরু করেন। আর এভাবেই সারা ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় ছানামুখী হয়ে যায় জনপ্রিয়।
এক কেজি ছানামুখী তৈরিতে সাত থেকে আট লিটার গরুর খাঁটি দুধ লাগে, যা এর উৎপাদন প্রক্রিয়ার সূক্ষ্মতাকে তুলে ধরে। প্রথমে দুধ থেকে ছানা তৈরি করা হয়। তারপর সেই ছানা ছোট ছোট ঘনকাকারে কেটে, এলাচ ও চিনির শিরায় ফেলে নাড়ানো হয়। এমনভাবেই কাজটা করতে হয়, যাতে ছানার টুকরোগুলো না ভেঙে যায়, আবার প্রতিটা টুকরোর উপর চিনির মিশ্রণ লেগে যায়। এরপর ছানা তুলে নিয়ে ঠান্ডা করা হয় এবং তারপরই তৈরি হয় ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ঐতিহ্যবাহী এই ছানামুখী।
জেলা প্রশাসন সূত্রে খবর, গত ২৪ শে সেপ্টেম্বর ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ছানামুখী মিষ্টিকে জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধিত করেছে। ডিপিডিটিতে ছানামুখী ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) নম্বর ৪১। বর্তমানে ছানামুখী শুধু ব্রাহ্মণবাড়িয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়, সরকারি ব্র্যান্ডিংয়ের আওতায় এটির পরিচিতি দেশের বাইরেও ছড়িয়ে পড়েছে। বিদেশি অতিথি এবং উচ্চ পর্যায়ের মন্ত্রীরা যখন ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আসেন, তাদের আপ্যায়নে ছানামুখী থাকবেই। ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টান্ন শুধু একটি মিষ্টি নয়, এটি এক অঞ্চল, এক জনগোষ্ঠী এবং তাদের সাংস্কৃতিক শিকড়ের পরিচয়ও বহন করে। ছানামুখীর এই স্বীকৃতি শুধুমাত্র ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ইতিহাসকেই সংরক্ষণ করেনি, বরং স্থানীয় মিষ্টি শিল্পের জন্য এক গর্বের প্রতীক হয়ে দাঁড়িয়েছে।
Discussion about this post