ঐতিহাসিক গুরুত্বের নিরিখে পশ্চিমবঙ্গের আনাচে কানাচে ছড়িয়ে রয়েছে বেশ দ্রষ্টব্য কিছু স্থান। এরকমই এক জায়গা হলো চন্দ্রকেতুগড়। কলকাতার উত্তর পূর্বে মাত্র ৩৫ কিমি দূরে ছোট্ট গ্রাম বেঁড়াচাঁপা গ্রামের মধ্যে এই স্থান। ১৯০০ সালে রাস্তার কিছু কাজ করতে করতে স্থানীয় এক ডাক্তার আবিষ্কার করেন এক ভাঙাচোরা শহরের আকৃতি। পাশ দিয়ে যেন বয়ে যাচ্ছে কোন শুকনো নদী। তিনি তখন ‘আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া’কে চিঠি লেখেন। তখন এর প্রত্নতাত্ত্বিক গুরুত্বের সন্ধানে ইতিহাসবিদ রা তৎপর হয়ে ওঠেন। অনুসন্ধান করে জানা যায় খ্রিস্টপূর্ব ৮০০ থেকে ৩০০ সাল পর্যন্ত এর বিস্তার ছিল। ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বে এর পুরনো ইতিহাস অনাবৃত হয়।
এর পর প্রায় দশ বছরের অনুসন্ধানে প্রকাশ পায় দারুণ তথ্য। এই শহর মৌর্য্যপূর্ব সময়ের সভ্যতার কেন্দ্র ছিল। এমনকি শুঙ্গা-কুষাণ ,পাল , সেন বংশের রাজত্বকালেও এর গুরুত্ব ছিল অসীম। অনেক ঐতিহাসিকের মতে, টলেমীর লেখা ‘জিওগ্রাফিয়া’ বইয়ে উল্লিখিত গঙ্গারিদাই বন্দর এই শহরের ই অংশ। পেরিপ্লাসের লেখাতেও এর উল্লেখ রয়েছে। এককালে বিশিষ্ট এই বাণিজ্য কেন্দ্র ছিল বাণিজ্যের পীঠস্থান। একটি ক্ষয়ে যাওয়া রৌপ্যমুদ্রা থেকে বোঝা যাচ্ছে, এটি অনেকগুলি জায়গা ঘুরে এখান এসেছে। এমনকি জানা গিয়েছিল এখানে ঘোড়ার ও রপ্তানি করা হতো। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাস ও জড়িয়ে রয়েছে এই জায়গার সাথে,তা হলো খনার ইতিহাস। লোকপ্রবাদে জানা যায় যে খনার শ্বশুরবাড়ি ছিল এই অঞ্চল। তার শ্বশুর বরাহমিহির ছিলের চন্দ্রগুপ্তের রাজসভার নবরত্নের এর রত্ন। বিশিষ্ট জ্যোতিষী খনার সঙ্গে এখানেই গড়ে ওঠে বিরোধ। এমনকি তার জ্যোতিষবিদ্যার চর্চাতেও বাধা দেওয়া হয়, তাঁর জিভ পর্যন্ত কেটে দেওয়া হয়। এখানকার খনা-মিহির ঢিবির সাথেই এর যোগসূত্র।
স্যাটেলাইট মানচিত্র থেকে যে নদীর ছবি দেখা যায় তা একসময় হয়তো গঙ্গাখাত ছিল। কিছু ঐতিহাসিকের মতে এই নদী ছিল বিদ্যাধরী নদী। এই নদী দিয়েই দেশ বিদেশে বাণিজ্যের পথ তৈরী হয়েছিল। মুদ্রাগুলিতে পালতোলা নৌকা, ঘোড়ার ছবিও দেখা গিয়েছে। এখানে পাওয়া গিয়েছে একটি বৌদ্ধমন্দিরও। যদিও হিউয়েন সাঙ বা ফা হিয়েনের লেখাতে এই নগরের কোন উল্লেখ নেই। তাই পঞ্চম শতাব্দী থেকেই হয়তো এই শহরের প্রতিপত্তি কমতে থাকে। যদিও হিউয়েন সাঙ ভারত থেকে ফিরে প্রায় কুড়ি বছর পরে তার অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করা শুরু করেন। তার ভারতে আসার অন্য উদ্দেশ্যেও ছিল। তাই তার স্মৃতি থেকে হারিয়ে যাওয়াও অস্বাভাবিক নয়।
এই অপূর্ব নিদর্শন এখন সংরক্ষিত রয়েছে কলকাতার আশুতোষ সংগ্রহশালা ও প্রত্নতাত্ত্বিক জাদুঘরে। কিছু নিদর্শন এই শহরে ও এই শহরের বাইরে ব্যক্তিগত সংগ্রহেও রয়েছে। এখন এই শহর কেবলমাত্র একটি দ্রষ্টব্য ঐতিহাসিক স্থান। সময়ের লীলাখেলায় এককালীন বিশিষ্ট এই সভ্যতার কেন্দ্র এখন কেবলমাত্র বাক্সবন্দি।
চিত্র ঋণ – সুমন কুমার গিরি, পিনাক পাণি
Discussion about this post