মাছে-ভাতে বাঙালির খাদ্যাভ্যাসে বাড়তি মাত্রা যুক্ত করেছে তুর্কি, আফগান, পর্তুগিজ, ইংরেজসহ নানান সংস্কৃতির খাবার। সময়ের বিবর্তনে যা এখন এদেশের রসনাবিলাসের অপরিহার্য অংশে পরিণত হয়েছে। তাই এখানকার যে কোনো হোটেল-রেস্তোরাঁতে ভাত-মাছের মতন নিরেট বাঙালি পদ যেমন পাওয়া যায়, তেমনি স্বাদ নেওয়া যায়- পোলাও, বিরিয়ানি, কাটলেট, কাবাবের মতো মুঘল ঘরানার মুখরোচক নানান খাবারের। রেস্তোরাঁ মানে শুধু খাওয়াদাওয়াই নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে রয়েছে বহু স্মৃতি, ঐতিহ্য ও ইতিহাস। তেমনই বহু স্মৃতি ও ঐতিহ্য জড়িত কলকাতার একটি রেস্তোরাঁ হল চাচা’স হোটেল। আধুনিকতার সাথে সাথে এই হোটেলটি নিজেদের পুরনো ধাঁচটিই ধরে রেখেছে। প্রায় ১৫০ বছরের পুরনো এই হোটেল।
চাচা’স হোটেল কলকাতার বিধান সরণীতে অবস্থিত একটি জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ। বিবেকানন্দের বাড়ির উল্টোদিকের ফুটে তাকালেই চোখে পড়বে লাল রঙের সাইনবোর্ড – যাতে লেখা চাচা’স হোটেল। শোনা যায় স্বয়ং স্বামী বিবেকানন্দ নাকি যৌবনকালে এই চাচার হোটেলের বিখ্যাত ফাউল কাটলেটের অন্যতম অনুরাগী ছিলেন। সুভাষচন্দ্র বোসও এখানে শিক কাবাব খেতে আসতেন। ২০২২ সালে পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গিয়েছে কলকাতার বুকে স্মৃতি-বিজড়িত এই চাচা’স হোটেল। তবে বন্ধ হলেও, এই হোটেলের স্মৃতি আর ইতিহাস আজও অটুট।
জানা যায়, ১৮৭৫ সালে গোঁসাই দাস পাত্রের হাতে এই হোটেলের উদ্বোধন হয়। উত্তর কলকাতায় স্বামী বিবেকানন্দের বাড়ির পাশেই জমি কিনেছিলেন তিনি। কিছুদিন পরে ওই জমির ওপরেই তৈরি হল চাচাস হোটেল। ওই জমির উপরেই ছিল চাচার চায়ের দোকান। তবে এই চাচার নাম জানা যায়নি। গোঁসাইদাস পাত্র জমি কেনার পর সেই চাচার চায়ের দোকান বন্ধ হয়ে যায় এবং তার নিজের একটা হোটেল তৈরি হয়। হোটেলের নাম ধাম কিছুই দেওয়া হয়নি তখনও। তবে কিছুদিনের মধ্যেই স্থানীয় মানুষেরা সেই হোটেলকে চাচার হোটেল নামে সম্বোধন করতে শুরু করলো। আর সেই থেকেই এই হোটেলের নাম হয়ে গেল চাচা’স হোটেল। শিক কাবাব, ফিশ ফ্রাই আর ফাউল কাটলেট দিয়ে শুরু হয়েছিল এই হোটেলের শুভযাত্রা। এরপর যুগের চাহিদা অনুসারে কিছু কিছু নতুন খাবার বানানো শুরু হল।
এত ইতিহাস-ঐতিহ্য জড়িয়ে থাকার সত্ত্বেও কেন বন্ধ হয়ে গেল চাচা’স হোটেল? এই প্রশ্নটা সবারই মনে আসবে! রেস্তোরাঁর মালিক অনুজকুমার পাত্র জানিয়েছেন, তার স্ত্রী মারা যাওয়ার পর তার এই ব্যবসার প্রতি আর কোনও আগ্রহ নেই। তার ছেলেও এই ব্যবসার প্রতি অনাগ্রহী। তাছাড়া দিন দিন প্রতিযোগিতাও বাড়ছে, আর তার সাথে টেক্কা দিয়ে এগিয়ে চলার জন্য নিত্য-নতুন ব্যবসায়িক আইডিয়াও প্রয়োজন। কিন্তু তার জন্য তেমন কোনও লোক নেই। এইসব কারণেই রেস্তোরাঁ বন্ধ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন তিনি। বিখ্যাত ফাউল কাটলেটের জন্যই একসময় গোটা কলকাতা চিনেছিল চাচাস হোটেলকে। কিন্তু এখন আর এই হোটেলের পাশ দিয়ে গেলে সেই ফাউল কাটলেটের গন্ধ ফিরে পাওয়া যাবে না। কারণ, কলকাতার বুক থেকে চিরতরে বিলীন হয়ে গেছে এই ঐতিহ্যবাহী চাচা’স হোটেল।
প্রচ্ছদ চিত্র ঋণ – sluurpy.in
Discussion about this post