খাওয়ার টেবিলে আভিজাত্য! পেতল কাঁসার থালা বহন করে তা। ঠাকুমার আদরের গোপাল থেকে জল খাওয়ার ঘটি। সাধারণ বাঙালি ঘরে পেতল কাঁসার ব্যবহার প্রচুর। এখন ফ্যান্সী বাসনের আগমনে সে খানিক পিছু হটেছে ঠিকই। কিন্তু পুজো-আচ্চার কাজ থেকে নিত্য প্রয়োজন, সবেই লাগে কাঁসা পিতল। রামজীবনপুরের ছ’নম্বর ওয়ার্ডের মানুষগুলো এই শিল্প নির্মাণেই জীবন নির্বাহ করেন।
কাঁসা পেতলের কলসি ও ছোটো পাত্রই মূলত নির্মাণ করেন রামজীবনপুরের শিল্পীরা। এখনও চলে বিনিময় প্রথা। আছেন মহাজন। মহাজনের থেকে কাঁচামাল আনেন শিল্পীরা। সেই কাঁচামাল থেকেই পিতলের কলসি বানান তাঁরা। সারাদিন কাটে এই কাজে। পরিবারের সকলেই প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত থাকেন এই পেশায়। কেউ দস্তা ভাঙেন। কেউ বানান মাটির ছাঁচ। কেউ ঠেলেন হাপর। কেউ আবার কলসির গায়ে নক্সা কাটেন। কর্মকার পল্লীর ঐ শিল্পীদের সাথে কথা বলে জানা যায়,”এই কাজে তেমন কোন লাভ হয় না। সারাদিন হাড়ভাঙা পরিশ্রম। টেনেটুনে সংসার চলে। যখন চাহিদা কমে যায়, তখন একেবারেই বসে যাই আমরা। দু’বেলা খাবার জোটানোই মুসকিল হয়ে ওঠে”। পঞ্চাশটি পরিবারের প্রায় পাঁচশো লোক কাজ করেন কাঁসা পেতলের।
পেতলের একটি কলসি বানাতে বেশ খাটনি। দস্তা ভেঙে তাতে পিতল মেশাতে হয় প্রথমে। তারপর মাটির ছাঁচ উনুনে বসাতে হয়। ওই পিতল ও দস্তার মিশেল গলে ছাঁচের ভেতর জমা হয়। ছাঁচ থেকে কিছুক্ষণ পর বের করা হয় কলসির দেহ। দেহ বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত থাকে। মুখ তৈরী হয় অন্য ছাঁচে। তলার অংশ ও মাঝের অংশ বানাতে লাগে অন্য ছাঁচ। এবার আসে জোড়ার পালা। জোড়া হয় মেশিনে। তারপর নক্সা করা। নক্সা ও পালিশ শেষ হলেই পাওয়া যায় পূর্ণাঙ্গ কলসি। এত পরিশ্রমের পর মেলে পয়সা। তাও আসে বদল বানীতে। তাই পরিবারের কেউই আর এই পেশা পরবর্তী প্রজন্মকে শেখাতে চান না। তাঁরা বললেন,”আমরা যেভাবে পারি চালিয়ে নিচ্ছি। এই মন্দার বাজারে ছেলেমেয়েরা পৈতৃক কাজ করে খেতে পাবে না। তাই সোনার কাজ শিখতে ওরা চলে গেছে।” হারিয়ে যাচ্ছে ঐতিহ্যের পিতল কাঁসা শিল্প। রান্নাঘরে আধুনিক বাসন ব্যবহার করতে গিয়ে আমরাই কি গলা টিপে হত্যা করছি না এসব প্রাচীন শিল্পকে!
Discussion about this post