কলকাতার ডালহৌসি স্কোয়ার (বর্তমানে বি.বা.দী.বাগ) থেকে শিয়ালদহ পর্যন্ত রাস্তাটির নাম জানেন সকলেই। বউবাজার স্ট্রীট। এটি কলকাতার অন্যতম ব্যস্ত, জনবহুল ব্যবসা-বাণিজ্যের এলাকা। শ্যামবাজার, মানিকতলা বাজার, বৈঠকখানা বাজার, লালবাজার, বাগবাজার প্রভৃতি কলকাতার বিখ্যাত কেনাবেচার অঞ্চলগুলি তাদের নামের সঙ্গে বহন করে চলেছে ইতিহাস। বউবাজারের ক্ষেত্রেও তার অন্যথা হয়নি। এই বাজারকে পূর্বে ‘বহু বাজার’ বলা হত। পড়ে অপভ্রংশ হয়ে হয়েছে বউবাজার। লোকের মুখে শোনা যায় কলকাতার কোনো এক ধনী মাড়ওয়ারি ব্যবসায়ি তাঁর পুত্রবধূকে এই এলাকা লিখে দিয়েছিলেন, সেখান থেকেই ‘বহু’বাজার। আবার অনেকের মতে বহু সামগ্রী কেনাবেচা হত বলেই নাম ‘বহু’বাজার। আজ অবশ্য বউবাজারের দাপ্তরিক নাম বিপিন বিহারি গাঙ্গুলি স্ট্রীট।
এই বউবাজারে হরেক রকম সামগ্রীর মধ্যেই মিলবে কলকাতার অন্যতম বড়ো গয়নার বাজার। বহু বছর আগে দুর্গা পিতুরি লেন, স্যাকরা পাড়া লেন, গৌর দে লেনের বেশকিছু বাড়িতে তৈরি হয়েছিল গয়নার কারখানা। আজও প্রাচীন বাড়িগুলি রয়েছে। আর রয়েছেন এই শিল্পের সাথে যুক্ত কারিগরেরা। বউবাজারের সোনাপট্টিতে গেলেই দেখা মিলবে এঁদের। বছরের পর বছর বংশানুক্রমে কারিগরেরা আগুনের পাশে বসে শতাব্দী প্রাচীন পদ্ধতিতে বানিয়ে চলেছেন সোনার গয়না। গালাই কারিগর, সোনার তার-টানা কারিগর, কাটাই পিস কারিগর, গড়িৎ কারিগর, পালিশ কারিগর, মিনার কারিগর, ফ্রস্টিং কারিগর মিলে মোট সাতজনের হাত ঘুরে তৈরি হয় একটি সোনার গয়না।
বউবাজারের গয়নাপাড়ার স্বর্ণশিল্পীদের সংখ্যা প্রায় দেড় লক্ষ। ধীরে ধীরে কমছে এই সংখ্যা। পাতালরেলের কাজের জন্য বারবার এই অঞ্চলের পুরনো বাড়িগুলিতে ফাটল ধরেছে, কখনও ভেঙেও পড়েছে। ভয়ঙ্কর ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন সোনার শিল্পীরা। কোভিডকালীন লকডাউন অনেকখানি ধ্বসিয়ে দিয়েছে ব্যবসা। এছাড়া বড়ো সোনার দোকানগুলি তৈরি হওয়ায় এই ছোটো কারিগরদের লাভের পরিমাণ গিয়েছে কমে। পুরো লাভই করেন দোকানের মালিকপক্ষ। সোনার দোকানগুলি সোনা আনাচ্ছে বাইরে থেকে। যন্ত্রের সাহাজ্যে অনেক কম সময়ে অনেক বেশি গয়না বানানো হচ্ছে। তৈরি হয়েছে ঝাঁ চকচকে শো রুম। ফলে হাতে গয়না বানানো বেশিরভাগ কারিগর কাজ ছেড়ে রিক্সা চালাচ্ছেন, সব্জি-মাছ বিক্রি করছেন। তাঁদের পরবর্তী জেনারেশন আসতে চাইছে না এই কাজে। যন্ত্র ও পুঁজির এই সমাজে আসতে আসতে অবলুপ্ত হতে চলেছে শিল্পীদের সোনার হাতের কাজগুলি। হেলে পড়া, জরাজীর্ণ রত্নভাণ্ডারগুলির খোঁজ হয়ত কিছু বছর পর আর কেউ করবেন না।
Discussion about this post