“আমরা দুটি ভাই/ শিবের গাজন গাই.” বসন্তের আমেজ পেরিয়ে রীতিমতো গরম পড়েই গেল। গাছে গাছে আমের মুকুল অন্তত: জানান দিচ্ছে বৈশাখ আসছে। চৈত্রের শেষ লগ্ন মানেই বাংলার অন্যতম লোকশিল্পের কথাই মাথায় আসে – গাজন। গাজন প্রাচীন বাংলার এক লোকাচার যেখানে নাচ-গান ও সাজ পোশাকের মাধ্যমে বিভিন্ন পৌরাণিক দেবদেবীর কথা স্মরণ করা হয়। দেব দেবী বলতে মনসা ধর্ম ঠাকুরের গাজন প্রচলিত থাকলেও চৈত্র সংক্রান্তির গাজন মূলতঃ শিবকে ঘিরেই। তাই বাংলার ঘরে ঘরে দুটি ভাই শিবের গাজন গেয়ে ডুগডুগি বাজাবার কথাই বহুল প্রচলিত। এই গাজনেরই একটি অংশ হল বোলান গান বা বোলান সংস্কৃতি।
অনেকে বুলানও বলেন, যেখানে ভক্তরা নানান বিচিত্র সাজে সেজে গোটা গ্রাম ঘুরে গান করেন। সঙ্গে চলে সংলাপ পাঁচালী ও নাচ। বোলান লোকশিল্পের জন্ম কীভাবে তার সঠিক হদিশ মেলে না। তবে অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন বাংলায় তুর্কি আক্রমণের পরে বোলানের শুরু। মুর্শিদাবাদের চারণ কবি পন্ডিত হরি নারায়ণের রচনায় প্রাচীন বাংলার বোলানের উল্লেখ পাওয়া যায়। ‘বোলান’ শব্দটির উৎপত্তি নিয়েও মতভেদ আছে। অনেক বিশেষজ্ঞ মনে করেন এই শব্দের অর্থ সম্ভাষণ। দেবদেবীকে নাচ-গানের মাধ্যমে ডাকা হয় বলেই এমন নাম।
মতান্তরে, ‘বুলান’ শব্দের অর্থ ভ্রমণ – গ্রাম ঘুরে ঘুরে এই লোকাচার পালিত হয় বলেই এমন নাম। আবার কেউ বলেন, গাজন সন্ন্যাসীদের প্রধানকে ‘বালা’ বলা হয়, সেই বালা থেকেই বোলানের উৎপত্তি। মূলতঃ রাঢ় বাংলার মুর্শিদাবাদ, বর্ধমান, নদীয়া, বীরভূমে বোলানের প্রচলন আছে। দলবদ্ধভাবে এই নাচ করতে হয়, প্রতিটি দলে একজন করে দলপতি থাকে। ছৌয়ের মতোই এখানেও মহিলারা নিষিদ্ধ – পুরুষেরাই নারীর সাজে সজ্জিত হয়। যদিও এখন কিছু জায়গায় নারীরাও অংশগ্রহণ করছে। বোলান বহু প্রকৃতির হয়, যদিও বিশেষভাবে প্রচলিত চার রকমের – দাঁড় বোলান ( যার তিনটি ভাগ: শৈব, ব্রহ্ম, সন্ন্যাস ), পালা বোলান, সখী বোলান ও শ্মশান বোলান।
বোলান নাচের সবথেকে ভয়ঙ্কর ভাগ হল এই শ্মশান বোলান। কেউ কেউ পোড়ো বোলানও বলেন। ভক্তরা গ্রামের শ্মশান থেকে মাটি খুঁড়ে প্রথমে মড়ার খুলি সংগ্রহ করেন। তারপর সারা দুপুর ধরে চলে বিচিত্র সাজগোজ, নানান রকম রং দিয়ে গোটা শরীরকে এক ভয়ঙ্কর রূপ দেওয়া হয়। তারপর গোটা রাত ধরে সেই খুলি ও অস্ত্র হাতে গোটা গ্রাম ঘুরে চলে এক একটি দলের নাচ গান। পরের দিন ভিক্ষাপাত্র হাতে ভিক্ষা নিয়ে শেষ হয় পোড়ো বোলান। শ্মশান বোলানের মধ্য দিয়ে শিবের ভক্তরা শ্মশানবাসী শিবের স্মরণ করে। শ্মশানবাসী দেবতার ভক্ত হিসেবেই তাই মড়ার খুলি হাতে ওমন বীভৎস নাচ। বোলান শুধু নিছক লোকাচার না, তা গ্রামবাংলার মানুষের জীবনের গল্প বটে। তাদের যাপিত জীবনের আখ্যান। মূলতঃ নিম্নবিত্ত মানুষের কোথাও ফুটে ওঠে এই আচার পালনে। বিশ্বায়নের দাপটে অন্যান্য সমস্ত লোকাচারের মত বোলানও ক্রমশঃ ফিকে হয়ে যাচ্ছে।
করোনার দাপটে এবছর সেভাবে কোথাও বোলান পালিত হচ্ছে না অবশ্য, তবুও সোনপলাশী, কুড়মুন, কেতুগ্রামের মত কিছু অখ্যাত গ্রামে এখনও বোলান পালিত হয়ে আসলেও গোটা বাংলা জুড়েই ধুঁকছে এই লোকাচার। এই সমস্ত গুটিকতক গ্রামের মানুষ অনেক লড়াই করে নিজেদের এই সংস্কৃতিকে ধরে রাখলেও কতদিন তা চালিয়ে যেতে পারবেন সে ব্যাপারে নিজেরাও সন্দিহান। নতুন প্রজন্মের এই আচারের প্রতি আগ্রহ কমছে। মাটি খুঁড়ে মড়ার খুলি খোঁজার রীতি আর নেই। খুলি বা স্কাল কিনতে হয়, যা যথেষ্ট দামি। প্রতিটি সাজপোশাকেরও যথেষ্ট খরচ।
অনেক দলপতিই দাবি করেন যদি সরকারি সাহায্য পাওয়া যায় তাহলে একই হয়তো বাঁচানো যাবে, নইলে অদূর ভবিষ্যতে এই লোকাচার ধীরে ধীরে হারিয়ে যাবে। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়ের গণদেবতা উপন্যাসে বোলান গানের উল্লেখ পাওয়া যায়। তাঁর উপন্যাসের চরিত্রদের মতো এই লোকাচারও হয়তো একদিন কোন অন্ধকারে তলিয়ে যাবে।
তথ্যসূত্র: বাংলার লোকসংস্কৃতি (ওয়াকিল আহমেদ )
সৌজন্য: ১. কৌলাল ২. সন্দীপন মুখোপাধ্যায়
সমস্ত ছবির স্বত্ত্বাধিকারী © শুভজিৎ নস্কর ও সন্দীপন মুখোপাধ্যায়
Discussion about this post