মহুয়ার চিরন্তন আকর্ষণ সঙ্গে দূর থেকে ভেসে আসা মাদলের শব্দ। কোথাও আবার ছোট বড় পাহাড়ের মাঝখান দিয়ে বয়ে চলেছে পাহাড়ি ঝরনা। হ্যাঁ ঠিকই ধরেছেন, এটা ‘ছৌ’-এর দেশ পুরুলিয়া। যার প্রাণ বলা যেতে পারে কংসাবতী বা কাঁসাই নদীকে। সেই কাঁসাইয়ের তীরেই জয়পুর থানা এলাকার দেউলঘাটা। যেখানে গেলে খোঁজ মিলবে প্রায় হাজার বছর পুরোনো কালো দুর্গার।
এখন প্রশ্ন উঠতেই পারে কালো দুর্গার মন্দির তাও আবার হাজার বছর পুরনো? তাহলে ইতিহাস হাতছানি দিয়ে উত্তর দেবে হ্যাঁ। প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে ভারতে পুরোনো যে কটি পোড়ামাটির মন্দির রয়েছে, তার মধ্যে এটি অন্যতম। স্থানীয়দের কাছ থেকে জানা যায় আগে তিনটি মন্দির ছিল এখানে। যদিও কালের নিয়মে ধ্বংস হয়ে গিয়েছে একটি মন্দির। তবে শুধু মন্দিরই নয় এখানকার বিগ্রহটিও মনের ভিতর জন্ম দেয় অনেক কৌতূহলের। ষাট ফুট উঁচু পোড়ামাটির মন্দিরের ভিতর রয়েছেন পাথরে খোদিত দশভূজা। তবে সঙ্গে নেই লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ চার পুত্র-কন্যার কেউই। কেবল আছেন মহিষাসুর এবং সিংহ। প্রচলিত দুর্গা প্রতিমায় দেবীর ডান পা সিংহের উপর এবং বাঁ পা থাকে মহিষাসুরের উপর। অবাক করার বিষয় এখানে ব্যাপারটি সম্পূর্ণ ভাবেই উল্টো। এই মূর্তিতে দেবীর ডান পা রাখা মহিষাসুরের উপর আর বাম পা রাখা সিংহের ওপর।
এই মূর্তির দিকে তাকালেই মনে হয় যেন হাজার হাজার বছরের রহস্য ও ইতিহাস বুকে বয়ে নিয়ে চলেছে। মন্দিরটি কারা প্রতিষ্ঠা করেছিল তা নিয়ে যথেষ্ট মতভেদ রয়েছে গবেষকদের মধ্যে। মূর্তির শরীরে বৌদ্ধ প্রভাব স্পষ্টভাবে লক্ষণীয়। আর মন্দিরের ত্রিকোণাকার দরজাও পরিচয় দেয় বৌদ্ধ ঐতিহ্যের। তাই হতে পারে এগুলি বৌদ্ধ মন্দির। আবার অন্য মতানুসারে, কাঁসাই নদীর তীরে একসময় বিকাশ ঘটেছিল জৈন ধর্মের। এই মন্দিরগুলি আসলে তাদেরই উপাসনাকেন্দ্র ছিল। তবে খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতকে দেউলঘাটা হয়ে উঠেছিল ব্রাহ্মণ্য ধর্মের কেন্দ্র। সম্ভবতঃ সেই সময় থেকেই পুজো শুরু হয়েছিল এই দুর্গা মূর্তির।
দেউলঘাটার মন্দির এবং মূর্তি কত পুরনো তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। তবে একটা বিষয় স্পষ্ট যে বাংলায় প্রাচীনকাল থেকেই দেবী দুর্গার উপাসনা হয়ে আসছে। আজও নিয়ম করে প্রতিদিন পুজো হয় এখানে। তবে দুর্গাপুজোর চারদিন থাকে উৎসবের মেজাজ। শুধু পুজোর সময়ই নয় প্রায় সারাবছরই এখানে ভিড় জমান পর্যটকরা। জৌলুস নয়, ইতিহাসের টানেই দেউলঘাটায় আসেন অনেকে। রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে জরাজীর্ণ অবস্থায় ইতিহাসকে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে রয়েছে ষাট ফুট উঁচু পোড়ামাটির এই ‘কালো দুর্গা’ মন্দির।
Discussion about this post