‛পাখমার’! – হয়তো এই নামটির সাথে অনেকেই পরিচিত নন। বাংলার একটি ব্যাধ সম্প্রদায় পাখমার। অজয় বা ভাগীরথীর তীরে, দুর্গাপুর, আউশগ্রাম, আসানসোলের গ্রামীণ অঞ্চলে আজও বাস করে এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা। একসময় এদের পূর্বপুরুষেরা বনে-জঙ্গলে পাখি শিকার করে দিন কাটাত। বলতে গেলে তারা ছিল যাযাবর। কিন্তু তারা প্রকৃতিগত ভাবে যাযাবর হলেও এখন এই সম্প্রদায়ের অনেকেই বাড়িঘর তৈরি করছেন। শিকার হওয়া পাখির জাতের উপর নির্ভর করে পাখমারদের মধ্যে চারটি উপসম্প্রদায় বা ‛থাক’ রয়েছে – জঙ্গীপুরী, কালকেতু-ফুল্লরা, জরাসন্ধ এবং দাঁইহাটি। এদের মধ্যে সামাজিকভাবে উচ্চস্থানে রয়েছে ‛কালকেতু-ফুল্লরা’ থাকটি।
পাখমারেরা আঠা দেওয়া বাঁশের ছিলার তৈরি ফাঁদ এবং সাতনলী নামে একধরনের অস্ত্র ব্যবহার করত শিকারের জন্য। মূলতঃ সাতটি সরু বাঁশকে পর পর গেঁথে তার উপরে একটি ভারী ধারালো ধাতুর তৈরি পাত লাগিয়ে সাতনলী নামক অস্ত্রটি তৈরি করা হত। কোনও পাখি গাছের উঁচু ডালে বসে থাকলে পাখমারেরা খুব সাবধানে এই অস্ত্র দিয়ে পাখিটিকে মেরে ফেলতেন। আজও রাঢ় বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলে সাতনলী অস্ত্রটি ব্যবহার করা হয়। এছাড়াও আবার সূক্ষ্ম জাল দিয়ে পাখি ধরা হত। বিশেষ করে, ছোট পাখি ধরার জন্য এই পদ্ধতিটি বেশি ব্যবহার হত। কিছু শিকারি ধনুক-বাণ ব্যবহার করেও পাখি শিকার করতেন।
পাখমারেরা ‛শিয়ালমারা’ নামেও পরিচিত। কারন, একসময় জামুড়িয়া, দোমহানি, আসানসোল অঞ্চলে বসবাসকারী শিয়ালদের তাড়িয়ে বন-জঙ্গল পরিষ্কার করে তাঁরা বসতি গড়ে তোলেন। পাখমারদের ধর্মীয় বিশ্বাস বৈচিত্র্যময়। বীরভূমের পাখমারেরা ধর্মঠাকুরের পুজো করেন। মুর্শিদাবাদে বৃক্ষপুজো করা হয়। পাখমারদের অন্যতম আরাধ্য দেবতা হলেন শিব। শিবকে তাঁরা নিজের বা পাখির রক্তে রঞ্জিত বেলপাতা নিবেদন করেন।
বর্ধমান রাজবাড়িতে বিজয়া দশমীর দিন রাজা কীর্তিচাঁদ কয়েকশো নীলকন্ঠ পাখি ওড়াতেন। আর এই পাখমারদের দায়িত্ব ছিল সেই নীলকন্ঠ পাখি জোগাড় করে আনা। শুধুমাত্র পাখি শিকার বা পাখি বিক্রিই নয়, এই সম্প্রদায়ের মানুষেরা বিভিন্ন জঙ্গল থেকে মধু সংগ্রহও করতেন। তবে বর্তমানে নগরায়নের ফলে বন-জঙ্গল কেটে ফেলা হচ্ছে। অরণ্যের সাথে সাথে হারিয়ে যাচ্ছে পাখিরাও। বর্তমানে পাখি শিকার অবৈধ ঘোষণা করা হয়েছে এবং এই অপরাধের জন্য কঠোর শাস্তির আইন রয়েছে। তাই পাখমারদের জীবন গেছে বদলে। তারা শিকার ছেড়ে অন্য পেশায় চলে গেছেন। তারা কেউ রিকশা চালিয়ে, কেউ বহুরূপী সেজে লোকজনের মনোরঞ্জন করে অথবা অন্য পেশা বেছে নিয়ে উপার্জন করছেন।
Discussion about this post