সময় বড়ই অদ্ভুত! একসময়ে যার কদর থাকে তুঙ্গে, সময়ের বিবর্তনে সেই কদরও আস্তে আস্তে হারিয়ে যায়। মানুষ তো বটেই প্রকৃতিও এই পরিবর্তনের হাত থেকে রেহাই পায় না। একসময়ের প্রবল প্রবহমান নদী যখন প্রাকৃতিক নিয়মে ব-দ্বীপ গঠন করে ধীরে ধীরে গতি হারিয়ে ফেলে তখন তাই খাল হয়ে যায়। প্রায় দুই হাজার বছর আগে গ্রীক জ্যোর্তিবিদ টলেমির বর্ণনায় যে বিশাল বিদ্যাধরী নদীর কথা আমরা জানতে পেরেছিলাম। সেই নদীই আজ উত্তর ২৪ পরগণার অশোকনগরের গুমার খাল। এমনকি এই খালই ছিল একসময়ের দ্বিগঙ্গা বা দ্বিতীয় গঙ্গা। গুমার খালের অতলে যে পরিমাণ প্রাকৃতিক গ্যাস ও তেলের সন্ধান পাওয়া গিয়েছে তাতে স্পষ্টত আন্দাজ করা যায় এই সম্পূর্ণ এলাকা ছিল বঙ্গোপসাগরে দখলে। রাজমহল পাহাড়ের কাছেই ছিল গঙ্গার মোহনা। এরপর নদী তার ব-দ্বীপ গঠনের কাজ শেষ করতে করতেই এই সমতল বিস্তীর্ণ ভূভাগ গড়ে তুলেছে।
আসুন এবার জেনে নিই এই বিদ্যাধরীর কিছু ইতিহাস। অবিভক্ত চব্বিশ পরগনার একটি বেশ গুরুত্বপূর্ণ নদী হল এই বিদ্যাধরী। এর বতর্মান উৎসস্থল হল নদীয়া জেলার বরগা বিল। সেখান থেকেই তা উত্তর চব্বিশ পরগণার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে সুন্দরবনের কালিন্দী রায়মঙ্গল নদীতে মিশেছে। ত্রিবেণীর পূর্বদিক দিয়ে হুগলি নদী থেকে যমুনা বহমান হওয়ার বহু আগেই বিদ্যাধরীই ছিল গঙ্গার নিম্ন অববাহিকার অন্যতম গতিপথ। ১৭৮১ সালের রেঁনেলের মানচিত্রে বর্তমান দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ক্যানিংয়ে মাতলা নদীর উত্তরাংশে বিদ্যাধরীর এক ধারা কাশীনাথপুর, মহেশ পুকুরিয়া, প্রতাপনগর হয়ে তারদহ, ধাপাবিল বাওড়ের উপর দিয়ে কলকাতার শ্যামবাজারের দিকে প্রবাহিত হয়েছে। গড়িয়ার বিখ্যাত তাড়দহ ছিল একসময়ের গুরুত্বপূর্ণ বন্দর। চব্বিশ পরগনায় পর্তুগীজদের প্রথম বসতিও এই বন্দরেই গড়ে উঠিছিল। তাড়দহের সেই টালির নালাও মিশেছে এই বিদ্যাধরীতেই।
যমুনার উৎসমুখ বন্ধ হওয়ার পর হরিণঘাটার বরগা বিলকেই এই মূহুর্তে বিদ্যাধরীর উৎসস্হল হিসাবে ধরা হয়। তবে বিদ্যাধরী যে আদিকাল থেকেই যমুনার শাখা নদী ছিল তা ঠিক মেনে নেওয়া যায় না। কারন যমুনাকে কোনো মতেই বিদ্যাধরী থেকে প্রাচীন নদী বলা যায় না। পুরাতাত্ত্বিক পরেশচন্দ্র দাশগুপ্ত, অতুল সুরের মতে মহেঞ্জোদাড়ো ও হরপ্পার থেকেও প্রাচীন সভ্যতার অস্তিত্ব পশ্চিমবঙ্গের সন্নিহিত এলাকায় পাওয়া যায়। উত্তর চব্বিশ পরগনার বেড়াচাঁপা, চন্দ্রকেতুগড়, হাদিপুর, মিনাখা প্রভৃতি পাওয়া গিয়েছে বিভিন্ন সময়ের প্রত্নবস্তুগুলি। যা অতীতের কথা জানতে যথেষ্ট সাহায্য করেছে। ঐতিহাসিক নীহাররঞ্জন রায়ের মতে খ্রিষ্টপূর্ব ৩০০ থেকে ৫০০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যে এই বিদ্যাধরীকে ঘিরেই চলতো আন্তর্জাতিক বাণিজ্য। বেড়াচাঁপা চন্দ্রকেতুগড়েই ছিল আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন গঙ্গাহৃদি বন্দর। পুরাতাত্ত্বিক এম এ জব্বারের মতে হাড়োয়া ও চন্দ্রকেতুগড়ের সভ্যতা ছিল প্রাক হরপ্পা যুগেরই। বারাসাত মহকুমার দ্বিগঙ্গা গ্রামটিও এক অতি প্রাচীন স্থান হিসাবেই জানা যায়। ইটের তৈরি ভগ্নাবশেষ ও প্রকান্ড দীঘি দেখেই আন্দাজ করা যায় এর বয়স।
ঐতিহাসিক বিভাবিজ এই দ্বিগঙ্গাকেই বিদ্যাধরীর তীরে গড়ে ওঠা সভ্যতার অস্তিত্ব হিসাবে দেখেছেন। আবার অনেকে এও অনুমান করেন যে একসময় বিদ্যাধরী ছিল ভাগীরথীর শাখা যা মজতে শুরু করলে দক্ষিণ পূর্বমুখী জমির ঢাল পরিবর্তন হওয়ায় নতুন প্রবাহ সৃষ্টি করে। এই প্রবাহই আজ যমুনা নদী নামে পরিচিত। এই যমুনার উৎপত্তির পরেই ভাগীরথী তার বিশালতা হারায়। ক্রমে তা সংকীর্ণ হতে হতে আজ এই অবস্থায় দাড়ায়। সেই মতো মনে করা হয় বিদ্যাধরীর আজকের এই অবস্থাও একই কারণে ঘটেছে।
তথ্য এবং চিত্র ঋণ – বালি হাঁস
Discussion about this post