সভ্যতা যতই উন্নতির পথে চলুক না কেন, প্রকৃত শিক্ষার আলো থেকে আজও বঞ্চিত কোটি কোটি ভারতবাসী। ফলে একবিংশ শতাব্দীতে এসেও কুসংস্কার-অন্ধবিশ্বাস-ধর্মীয় গোঁড়ামি মন থেকে পুরোপুরি মুছে ফেলা যায়নি। তবে নিরন্তর সচেতনতামূলক প্রচারের ফলে মানুষ এখন আগের তুলনায় অনেক বিচক্ষণ। আর সেই কৃতিত্বের অন্যতম ভাগীদার ‘ভারতীয় বিজ্ঞান ও যুক্তিবাদী সমিতি’। প্রায় সাড়ে তিন দশক ধরে যাবতীয় অন্ধবিশ্বাসকে বৈজ্ঞানিক যুক্তির সাহায্যে ধূলিসাৎ করে চলেছেন তাঁরা। কিন্তু সেই কাজ করতে গিয়েই এবার প্রবল রোষের মুখে পড়লেন সমিতির সদস্যরা!
জন্ডিসের মালা পরা কুসংস্কার, এই শীর্ষক মূল ভিডিও
ঘটনার প্রেক্ষাপট হল সমিতির অন্যতম কর্মসূচী – জনসমক্ষে বিভিন্ন অলৌকিক ঘটনাকে বৈজ্ঞানিক উপায়ে হাতে কলমে ব্যাখ্যা করা। এর পোশাকি নাম ‘বিজ্ঞান অভিযান’। তারই অংশ হিসেবে প্রতি বছর নভেম্বর মাসের কোনো একটি সময় বেছে নিয়ে সমিতির বিভিন্ন শাখা একসাথে পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ‘সারা বাংলা বিজ্ঞান অভিযান’ আয়োজন করে। ২০১৮ সালে কর্মসূচীর অংশ হিসেবে উত্তর কলকাতার বউবাজারের বিখ্যাত ‘সন্তোষ মিত্র স্কোয়্যার’ বা ‘নেবুতলা পার্ক’-এ একটি অনুষ্ঠান হয়। সমিতির তরফে অংশ নেন সুদীপ দে সরকার, দেবকুমার হালদার, গৌতম ঘোষ, দীপক রায়, সংগ্রাম অগস্তি, দেবাশীষ ভট্টাচার্য প্রমুখ। উপস্থিত দর্শকদের সাথে তাঁদের যুক্তি-তক্কো-গপ্পের মাধ্যমে অনুষ্ঠানটি সম্পন্ন হয়।
সেই সময়ই সমিতির কলকাতা শাখার সদস্য সংগ্রাম বাবু অনুষ্ঠানের একটি ভিডিও বানিয়ে ফেসবুকে তুলে ধরেন। সেই ভিডিওতে দেখা যাচ্ছে, দেবাশীষবাবু ‘জন্ডিসের মালা’ বা ‘ন্যাবার মালা’ নিয়ে নিজের যুক্তিবাদী বক্তব্য রাখছেন। বিষয়টি ঠিক কী? জন্ডিস সারাতে কিছু ভণ্ড গাছের ডাল দিয়ে তৈরী ‘অলৌকিক শক্তিসম্পন্ন’ এক মালা ধারণ করতে বলে থাকেন। এই মালা নাকি শরীর থেকে জন্ডিস টেনে নিয়ে অলৌকিক ভাবে বাড়তে থাকে। অবশেষে রোগী সুস্থ হলে নিজে থেকেই শরীর গলে বেরিয়ে যায়! আসলে দুটি কারণে এই তথাকথিত অলৌকিক ঘটনা ঘটে। প্রথমত, মালা গাঁথার কাজে আপাং, ভৃঙ্গরাজ জাতীয় কিছু গুল্মের ডাল ব্যবহার করা হয়, যা খুব তাড়াতাড়ি শুকিয়ে যায়। দ্বিতীয়ত, একটি বিশেষ ফাঁস ব্যবহার করে মালাটি গাঁথা হয়, যার নাম ‘সিফার্স নট’। এতে মালার মাঝে থাকা ওই বিশেষ ডালের টুকরো যত শুকোতে থাকে, ফাঁসও ততই কমে যায়। স্বাভাবিকভাবেই কিছু সময় পর মালাটি কয়েক গুণ বেড়ে ওঠে! এদিকে রোগী কিন্তু সুস্থ হন সম্পূর্ণ বিশ্রাম ও উপযুক্ত খাদ্য গ্রহণের কল্যাণে!
সম্প্রতি এই ভিডিওটিই ফের সামাজিক মাধ্যমে ভাইরাল হয়। তারপরেই দেখা যায়, বহু মানুষ তাঁদের সমর্থন জানিয়ে গেলেও, শয়ে শয়ে মানুষ এসে বিরোধিতা করে যাচ্ছেন ভিডিওটির। হুমকির সাথে সাথে চলছে অশ্রাব্য গালিগালাজও! সঠিক জিনিসটি বোঝার চেষ্টা তো দূর অস্ত, উল্টে যুক্তিকেই দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে ‘ভণ্ডামি’ বলে! স্বাভাবিকভাবেই তাজ্জব বনে যান সমিতির সদস্যরা। ‘ডেইলি নিউজ রিল’-এর তরফে দেবাশীষবাবুর সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, “কুসংস্কার থেকে মানুষকে বের করে আনার জন্যই আমরা কাজ করে চলেছি। মানুষের কাছে পৌঁছনোর ক্ষমতা আমাদের অল্পই। তাও দীর্ঘদিনের প্রচারের ফলে কুসংস্কারের প্রকোপ এখন অনেকটাই কম। তবুও মানুষের মন থেকে যে তা পুরোপুরি লুপ্ত হয়ে যায়নি, তার প্রমাণ এই গালিগালাজ। যাঁরা বিরোধিতা করছেন তাঁদের উপর আমার কোনও ক্রোধ নেই, কিন্তু ওঁদের জন্যই আমাদের কাজ চালিয়ে যেতে হবে।” ২০২২ সাল দরজায় কড়া নাড়ছে। সেই সময়ে দাঁড়িয়েও অন্ধবিশ্বাসের হয়ে ওকালতি করা যে নিতান্তই নির্বুদ্ধিতার পরিচায়ক, সে কথা তো বলাই বাহুল্য!
Discussion about this post