আজ বসন্ত সংক্রান্তি। চৈত্রের শেষ দিন। আজ চড়ক পুজোও বটে। তবে চড়ক ছাড়াও বসন্তের এই শেষ দিনে বাংলার মানুষ মেতে ওঠেন চৈত্র সংক্রান্তির বিশেষ এক পার্বণে। বিশেষ করে ওপার বাংলার মানুষদের কাছে এই উৎসব বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ। এই পার্বণকে ‘ভাই ছাতু’ উৎসবও বলা হয়ে থাকে। এই বিশেষ দিনে অনেক পরিবারে ভাইয়ের মঙ্গল কামনায় ঠিক ভাইফোঁটার মতই পালন করা হয় ‘ভাই ছাতু’ উৎসব। আজ বাংলার লুপ্তপ্রায় সংস্কৃতিতে এই সব ছোট ছোট উৎসবগুলোকে আমরা প্রায় ভুলতেই বসেছি। তবে এখনও বেশ কিছু পাড়া গাঁয়ের পল্লী সংস্কৃতিতে টিকে রয়েছে এই ছাতু উৎসব।
চৈত্র সংক্রান্তির দিনে প্রতিবছর পাড়া গাঁয়ে ছাতু কোটার ধুম শুরু হয়ে যায়। আগে ঢেঁকিতে কোটা হত গম, যব এবং ছোলার ছাতু। তবে এখন আর সেই ঢেঁকি কোথায়! মেশিনের সাহায্যেই ছাতু কোটা হয়ে থাকে। চৈত্রের শেষ দিনে দিদিরা ভাইদের মঙ্গল কামনায় পালন করে ছাতু উৎসব। কিছুটা যেন সেই অকাল ভাইফোঁটা! ভাই ছাতুতে প্রধানত যবের ছাতুই ব্যবহৃত হয়। এইদিন সকালে স্নান সেরে প্রথমে ভাইয়ের কপালে চন্দনের তিলক কেটে দেন দিদি-বোনেরা। তারপর পরপর তিনবার ভাইয়ের হাতে তুলে দেওয়া হয় টক দই, তেঁতুল জল, চিনি আর নুন দিয়ে মাখা যবের ছাতুর মণ্ড। মণ্ডের স্বাদ বাড়াতে তাতে যোগ করা হয় মুড়ি, চিঁড়ে, মুড়কি, টক দই। ঠিক ভাইফোঁটার মতই এরপর ভাই-বোন একে অপরের হাতে তুলে দেয় উপহার। তবে এইদিন কিন্তু আমিষ খাবার খাওয়া একেবারে নিষিদ্ধ। দিদি-বোনেরা নিজের হাতে ভাইকে পঞ্চব্যঞ্জন রেঁধে খাওয়ায়। তবে সবটাই নিরামিষ। পাতে জায়গা করে নেয় কাঁচা আম এবং তেতোর নানান পদ।
ছাতু উৎসবের দিন বিকেলে গ্রাম-বাংলার মহিলারা কোনও জলাশয়ের ধারে দাঁড়িয়ে কুলোর বাতাস দিয়ে ছাতুর ধুলো উড়িয়ে দেন। এরপর একসঙ্গে বলে ওঠেন- “শত্রুর মুখে দিয়া ছাই, ছাতু উড়াইয়া ঘরে যাই।” সেই ছাতু উড়ে গিয়ে মেশে পথঘাটের ধুলোর সঙ্গে। অস্ত যাওয়া পুরোনো বছরের শেষ সূর্যের রক্তিম আভাকে ঢেকে দেয় সেই ছাতু-ধুলোর ঝড়! এভাবেই চৈত্রের শেষ দিন থেকেই নতুন বছরকে স্বাগত জানানোর প্রস্তুতি শুরু হয়ে যায়। আজকাল খুব কম সংখ্যক পরিবারে এই ভাই ছাতুর উৎসব পালিত হয়ে থাকে। ভুলতে থাকা সংস্কৃতির কালের গর্ভে এই সনাতনী প্রথা ক্রমশঃ হারিয়ে যাচ্ছে। তবে বেশ কিছু পল্লী গ্রামে এখনও নিষ্ঠা সহকারে পালিত হয়ে আসছে এই প্রথা। এ বছর করোনার দাপটে বন্ধ যে কোনও উৎসবই। তবে এই আকালের দিন কেটে গিয়ে বৈশাখের রোগমুক্ত বাতাসে এসে লাগবে আমাদের গায়ে। এই আশাতেই দিন গুনে চলেছি আমরা।
Discussion about this post