মাটির তৈরি থালা। তাতে আঁকা হয়ে চলেছে ছবি, দেওয়া হচ্ছে রং। সেই থালাকেই সাজিয়ে রেখে করা হচ্ছে লক্ষ্মী পুজো। এই দৃশ্য পূর্ব এবং পশ্চিম বাংলাসহ সমগ্র লোকসমাজে খুবই স্বাভাবিক। বিজয়ার রেশ কাটতে না কাটতেই শুরু হয় বাঙালির সুখ, সমৃদ্ধির দেবী লক্ষ্মীর পুজোর তোড়জোড়। সারা বছরে বাঙালির সংস্কার, পুজো-আচ্চার হিসেব করলে ‘বারো মাসে তের পার্বণে’র বদলে তেইশ পার্বণও হতে পারত সম্ভবত। আর সেই পার্বণের রকমফেরও নেহাত কম নয়। বিভিন্ন পুজোর বিভিন্ন নিয়ম, আবার কখনও একটি পুজোরই বিভিন্ন জেলায় বিভিন্নরকমের নিয়ম। লক্ষ্মীপুজোর ক্ষেত্রেও সেই বিভিন্নতা বহাল।
মূলত ঘট, সরা ও মূর্তি দিয়েই বছরের বিভিন্ন সময়, বিভিন্ন রীতিনীতি তে হয়ে থাকে লক্ষ্মী পুজো। তবে বাংলায় সরায় লক্ষ্মী পুজো বেশি হয়। গোলাকার, অগভীর এবং প্রসারিত পাত্র হল সরা। এটি থালার চেয়ে ছোটো এবং কম গভীরতা সম্পন্ন। গ্রামবাংলায় সাধারণত হাঁড়ি বা কলসির মুখ ঢাকার জন্য মাটির তৈরি এই সরা ব্যবহার করা হয়। সরার উপরের অংশ ঘসে মসৃণ করে খড়ির প্রলেপ দেওয়া হয়। তারপর উজ্জ্বল রং ব্যবহার করে ফুটিয়ে তোলা হয় দেবদেবীর চিত্র। আঞ্চলিকতা ভেদে লক্ষ্মী সরায় তিনটি, পাঁচটি এবং সাতটি পুতুল আঁকা হয়। এতে থাকে লক্ষ্মী, জয়া বিজয়া-সহ লক্ষ্মী, রাধাকৃষ্ণ, সপরিবার দুর্গা ইত্যাদি। অলঙ্করণ হিসেবে থাকে ধানের শিস, পদ্ম, লতাপাতা।
প্রাচীনকালে বৈষ্ণব, শাক্ত এবং শৈবরা ধর্মীয় প্রয়োজনে সরা ব্যবহার করতেন। তবে অবাক করা বিষয় হল, ইসলাম ধর্মের মানুষের মধ্যেও সরার ব্যবহার দেখা যায়। বাংলাদেশের টাঙ্গাইলে, গাজির সরা এবং মহরমের ছবি আঁকা মহরমের সরাগুলি এর বড় প্রমাণ। পুজো-পার্বণ, ধর্মীয় নানা উপচার-অনুষ্ঠানে সরা আঁকার রেওয়াজ চলে আসছে সেই প্রাচীনকাল থেকে। বংশ-পরম্পরায় এই সরা আঁকা চলছে আজও। মুসলমান সরাচিত্রশিল্পীদের আঁকা লক্ষ্মীর সরাতে কাবার ছবি এবং বিভিন্ন সংখ্যার মান লেখা থাকত। এই সরা পরিচিত গনকী সরা নামে। অর্থাৎ, ধর্ম এবং পুজোর রীতিনীতির বাইরেও এই সরার শিল্প এক অন্যরকম সম্প্রীতির চিত্র বহন করে বাংলার ইতিহাসে।
বাংলায় এই সরা চিত্রকলার ঐতিহ্য বহুকালের পুরনো। সরাচিত্রের বিস্ময়কর সংগ্রহ আজ বিশ্বব্যাপী ছড়িয়ে পড়েছে। সংগ্রাহকের সংখ্যাও কম নয়। দেশভাগের পর এবং বিশ্বায়নের কারণে সরায় লক্ষ্মী পুজোর ঐতিহ্যও ছড়িয়ে পড়েছে পূর্ববঙ্গ থেকে পশ্চিমবঙ্গ ও সারা দেশে। পূর্বে গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে দেবতার আসনে বছরভর পুজো পেত এই সরাগুলি। বর্তমানে শহুরে বাঙালির ঘরে, বা আধুনিক ফ্ল্যাটেও জায়গা করে নিয়েছে রং-বেরঙের মাটির সরা। শোভাবর্ধন করতে বাংলার এই নিজস্ব শিল্পকলার জুড়ি মেলা ভার যে!
Discussion about this post