এমন প্রচুর গল্প লোকমুখে ঘুরে বেড়ায় যেখানে ঈশ্বর স্বয়ং একটি মানুষকে দেবত্বের পর্যায়ে উন্নীত করে থাকেন। ভারত এমন একটি দেশ যার গল্প ভান্ডার অত্যন্ত সমৃদ্ধ। যুগ যুগ ধরে নানা গল্প কথা এই দেশের সংস্কৃতির সাথে একাত্ম হয়ে গিয়েছে। এদেশে ষোড়শ শতকের শেষ দিক থেকে ভক্তি আন্দোলনের সূচনা হয়। এই আন্দোলন শুধু ভারতীয় দর্শনকেই সমৃদ্ধ করেনি, বরং ভারতীয় ধর্ম ভাবনায় এক যুগান্তকারী পরিবর্তন আসে। ঈশ্বর একজন অভিভাবক স্থানীয় চরিত্রের থেকে একজন বন্ধু হিসেবে প্রতিপন্ন হতে লাগলেন। নিজামুদ্দিন আউলিয়া, আমির খসরুর মতো মানুষের হাত ধরে সুফিবাদের আগমন এই আন্দোলনকে আরও জোরদার করে তোলে। এই আন্দোলনের পথিকৃৎ হিসেবে আমরা যতই গুরু নানক, কবির, কালিদাস, বুল্লে শাহ, রামপ্রসাদ সেনের নাম মনে করি, ততই বিস্মৃতির অন্ধকারে তলিয়ে যান মুঘল আমলের ভক্তিবাদী কবি ‘ভক্ত সালবেগ’। তিনি সারা জীবন প্রাণপাত করে জগন্নাথ দেবকে উৎসর্গ করে ওড়িয়া ভাষায় ভজন লিখে গিয়েছেন। কিন্তু তবুও আমৃত্যু তাকে পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে ঢোকার অনুমতি দেওয়া হয়নি।
ভারতীয় পুরাণ এমন অনেক গল্পে সমৃদ্ধ যেগুলি ঈশ্বরের মানুষের সঙ্গে বন্ধু হওয়ার গল্প বলে। সে রামচন্দ্রের কবি কালিদাসের সাথে ছদ্মবেশে দেখা করে বন্ধুত্ব পাতানোর গল্পই হোক, কিংবা চণ্ডীমঙ্গলে দেবী চণ্ডীর মূল চরিত্র কালকেতুর দ্বিতীয় বিবাহিতা স্ত্রী হিসেবে প্রথম স্ত্রী ফুল্লরার সাথে সই পাতানোর কাহিনী। যদিও এই গল্পের সত্যতা নিয়ে তর্ক বিতর্ক ভিত্তিহীন, তবুও এই গল্পগুলি চিরকাল ভারতে ঈশ্বর ও মানুষের মধ্যে অবস্থিত ক্ষীণ রেখাটি ঘুচিয়ে দিতে পেরেছে।
“କୁରୁସଭାତଳେସୁଣିଦ୍ରୁପୌଦିରଜଣାଣ,
କୋଟିବତ୍ସ୍ରଦେଇହେଲେଲଜ୍ଜାକଲବାରଣ” – ସାଲବେଗ
(কুরুসভা থেকে দ্রৌপদীর কাতর আর্জি শুনে,
কটিবস্ত্র দান করে তার লজ্জা আপনি নিবারণ করলেন – সালবেগ)
ভুবনেশ্বরের রিজিওনাল ইনস্টিটিউট অফ এডুকেশনের ইতিহাসের অধ্যাপক শ্রী প্রীতিশ আচার্য বলেন, “অনেক পণ্ডিতের মতে, সালবেগের জন্ম ১৬০৬ (মতান্তরে ১৬০৭) খ্রিষ্টাব্দে।” বড় হয়ে সালবেগ নিজের বাবার মতই দুর্ধর্ষ যোদ্ধা হয়ে উঠলেন। একের পর এক বহিরগতদের আক্রমণ প্রতিহত করে তিনি মোঘল রাজ দরবারেও অত্যন্ত প্রিয়পাত্রও হয়ে উঠলেন। পরাক্রমশালী সৈনিক থেকে একজন জগন্নাথ ভক্ত হয়ে ওঠার পেছনে মনে করা হয়ে থাকে যে তার মায়ের হাত আছে। প্রচলিত লোক কথা অনুসারে, একবার যুদ্ধ থেকে ফিরে সাংঘাতিক জ্বরে পড়লেন সালবেগ। তার মায়ের নির্দেশ অনুসারে সালবেগ প্রভু জগন্নাথের কাছে তার সুস্থতা কামনা করে প্রার্থনা করতে লাগলেন। তিনি সেরেও উঠলেন এবং তারপরেই জগন্নাথের একনিষ্ঠ ভক্ত হিসেবে আত্মপ্রকাশ করলেন। যদিও এই গল্পগুলির কোন প্রামাণ্য তথ্য নেই। তবে এগুলি উড়িষ্যার মানুষের কাছে যুগ যুগ ধরে লোকমুখেই শুধু প্রচারই পায়নি, বিশ্বাস হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। তিনি তার প্রাণের ঠাকুরকে দেখতে তাই চলে গেলেন পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে। কিন্তু মন্দিরের নিয়ম অনুযায়ী উচ্চবর্ণের হিন্দু ছাড়া কাউকে মন্দিরে ঢুকতে দেওয়া হতো না। হতাশ ও অপমানিত সালবেগ বৃন্দাবন অভিমুখে যাত্রা করেছিলেন বলে শোনা যায়।
“ଆହେନିଳଶୈଳପ୍ରବଳମତ୍ତବାରଣ
ମୋଆରତନଳିନିବନକୁକରଦଳନ” –ସାଲବେଗ
(ওহে নীল পাথরের ভগবান, হস্তীর মতন শক্তিমান
আমার পঙ্কিল মনে পদ্মের মতন ফুটে ওঠো – সালবেগ)
একজন মুসলমান হবার জন্য সালবেগ কোনদিনই মন্দিরে গিয়ে প্রভু জগন্নাথের দর্শন পাননি। তাই তিনি কৌশলে বৃন্দাবন থেকে ফেরার সময় জগন্নাথ দর্শনের দিন হিসেবে বাছলেন রথযাত্রার দিনটি। কিন্তু পথে তার দেরি হয়ে যায়। তিনি প্রার্থনা করতে থাকেন প্রভুর কাছে, প্রভু যেন না তার না পৌঁছনো অবধি অপেক্ষা করেন। লোক কথা অনুসারে, সালবেগ না আসা পর্যন্ত রথের চাকা একচুল গড়ানো যায়নি।
অন্য একটি লোক কথা অনুযায়ী, তিনি একবার দিল্লি থেকে পুরী ফিরছিলেন বালাসোর হয়ে। সেই সময়ে তিনি বালাসোরের স্বামীনারায়ণ মন্দিরের কাছে আশ্রয় নিলেন কিছুদিন বিশ্রাম করার জন্য। কিন্তু তিনি সন্ধ্যা-আরতি দেখার ইচ্ছা প্রকাশ করলে, তাকে মন্দিরের ভিতর ঢুকতে বাধা দেওয়া হয়। তাই সালবেগ নিজের বিছানায় শুয়ে মন দিয়ে আরতির ভজন ও কৃষ্ণমহিমা শুনতে লাগলেন ও সেগুলি আত্মস্থ করতে লাগলেন। পরের দিন হঠাৎ মন্দিরের প্রধান পুরোহিত দেখলেন, গর্ভ গৃহ থেকে মূর্তি উধাও হয়ে গেছে। সেই রাত্রেই বালাসোরের রাজা স্বপ্নে দেখলেন যে দেবতা তার মন্দির ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন তার প্রিয় ভক্তের সাথে দেখা করার জন্য। এই স্বপ্ন দেখার পরেই, রাজা তক্ষণাৎ মন্দিরের দেওয়ালে ফুটো করার আদেশ জারি করলেন। সালবেগ সেই ছিদ্রে চোখ লাগাতেই দেবতা আবার নিজের জায়গায় আবির্ভূত হলেন। সালবেগও আরতি দেখতে সমর্থ হলেন। ভারতের মতন এমন দর্শনসমৃদ্ধ দেশে, গল্পকথাগুলি আর গল্প থাকে না। এক জলজ্যান্ত মানুষের জীবনের অঙ্গ হয়ে পড়ে। সালবেগের জীবনও এইরকম নানান গল্পকথার মাধ্যমে অলঙ্কৃত হয়েছে।
“କହେସାଲବେଗହିନଜାତିରେମୁ୍ଁଜବନ
ଶ୍ରିରଙ୍ଗାଚରଣତଲେକରୁଛିମୁଁଜଣାଣ” –ସାଲବେଗ
(সালবেগ কাতর কন্ঠে জানায়, আমি জাতিতে যবন
শ্রীজগন্নাথের চরণের আশ্রয় তলে জন্ম গ্রহণ করছি – সালবেগ)
ভিন ধর্মে জন্ম তার ভক্ত সাধনার মাঝে কখনোই অন্তরায় হয়ে উঠতে পারেনি। তিনি একজন মুসলিম কবি হয়েও একের পর এক ভজন লিখে গিয়েছেন তার প্রিয় প্রভুর জন্য। যিনি প্রভুর চেয়েও বেশি, একজন বন্ধু! মজার ঘটনা এই যে, ওড়িয়া লোককথাগুলি সালবেগকে প্রধান ভক্তের আসনে বসিয়ে পরোক্ষভাবে কিন্তু মন্দিরের এই রীতি রেওয়াজগুলির সমালোচনাও করে থাকে। একজন ভক্ত যে সারা জীবন তার প্রভুর মন্দিরে প্রবেশ করতে পারেনি, এই গল্পগুলিতে বারবার তা সমবেদনার সুরে ধ্বনিত হতে থাকে। ভারতের ধর্মীয় গল্পগুলি যে ধর্মের বেড়াজাল পেরিয়ে আত্মসমালোচনা করেও বিখ্যাত হয়েছে, এটি তার উৎকৃষ্ট প্রমাণ।
দুঃখের কথা এই, যে সালবেগের বেশিরভাগ লেখা আর সময়ের আবর্ত পেরিয়ে আর আমাদের মধ্যে সংরক্ষিত হয়ে থাকতে পারেনি। শোনা যায়, তিনি মৃত্যুর আগে বলেছিলেন, “যদি আমার ভক্তির জোর থাকে, প্রভু আমার মৃত্যুর পর আমার কবরে আসবেন।” সালবেগকে মৃত্যুর পর জগন্নাথ মন্দির ও গুণ্ডিচা মন্দির অর্থাৎ জগন্নাথের মাসির বাড়ির মাঝে কবর দেওয়া হয়। বর্তমানে এই কবরটি পুরীর গ্র্যান্ড রোডের ওপর পড়ে যেখান দিয়ে রথযাত্রা যায়। সালবেগের মৃত্যুর পর, হঠাৎ রথযাত্রার সময় রথের চাকা সালবেগের কবরের সামনে আটকে যায়। শত চেষ্টা করেও তাকে সরানো না গেলে, তৎকালীন উৎকল রাজ্যের হিন্দু রাজা সবাইকে সালবেগের নামে জয়ধ্বনি দিতে আদেশ দেন। জয়ধ্বনি উঠতেই আবার গড়াল রথের চাকা। এই রীতি আজ অবধি পালন করা হয় রথযাত্রার সময়। এইভাবে স্বয়ং ভগবান তার বন্ধুকে অমর করে দিয়ে গেলেন। তবুও এতো কিছুর পরেও, আজও পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে সালবেগের স্বজাতি ‘যবন’দের প্রবেশ নিষিদ্ধ!
*উদ্ধৃত লাইনগুলি সালবেগ এর লেখা সবচেয়ে জনপ্রিয় ভজন ‘আহে নীল শৈল’ (ওহে নীল পাথরের ভগবান) থেকে গৃহীত।
Discussion about this post