অঞ্জন দত্তের বেলা বোস গানটা আজও মুখে মুখে চর্চিত। বেলা বোস কবে থেকে যেন বাংলার কত কাছের, কত চেনা এক মুখ। কিন্তু বাংলার সেই অতিপরিচিত গানটার বহু আগে থেকেই বাংলাকে মাতিয়ে রেখেছে বেলা বিস্কুট। প্রায় ২৫০ বছর আগের কথা। নদী ও সমুদ্রে ঘেরা চট্টগ্রামে বসবাস ছিলো পর্তুগিজ ও ইংরেজদের। ভেতো বাঙালির খাদ্যাভাসের সাথে তাদের খাদ্যাভাসের ছিলো আকাশ পাতাল তফাৎ। পর্তুগিজ ও ইংরেজদের তিনবেলা আহার বলতে রুটি, পাউরুটি, বিস্কুটসহ বেকারি পণ্য। কিন্তু পূর্ববাংলার চট্টগ্রামে তখনও চালু হয়নি বেকারি শিল্পের।
এই সুযোগকে কাজে লাগালেন পশ্চিম বঙ্গের বর্ধমান জেলার বেকারি ব্যবসায়ী সওদাগর লাল খাঁ সুবেদার ও তার ছেলে কানু খাঁ মিস্ত্রি। চট্টগ্রামে তাদের আসার মধ্য দিয়েই শুরু হলো বেকারি শিল্পের।শুরুতে তৈরি হতো সাধারণ রুটি। এরপর ধীরে ধীরে তৈরি শুরু হয় পাউরুটি, কেক। যদিও বিস্কুট তৈরি শুরু হয়েছে আরও অনেক পরে। এই লাল খাঁ সুবেদারের পরবর্তী বংশধর আব্দুল গণি সওদাগর পর্তুগিজদের কাছ থেকে বিস্কুট বানানোর প্রণালী জেনে ১৮৭৮ সালে চট্টগ্রামে সর্ব প্রথম বিস্কুটের প্রচলন ঘটান। এই বিস্কুটের নাম রাখা হল ‘বেলা বিস্কুট’ যা আজও সারাদেশে সমানভাবে জনপ্রিয়। মোগল, পর্তুগিজ বা ইংরেজদের মতো বেকারি পণ্যেও অভ্যস্ত হতে থাকে এ অঞ্চলের সর্বস্তরের মানুষেরা।
মজার বিষয় হলো বেলা বিস্কুটের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। সেটি হলো বেলা বিস্কুট তৈরিতে তারা এখনো সেই পুরনো পদ্ধতিকেই অনুসরণ করে থাকে। আধুনিক বেকারির মতো ওভেনে তৈরি হয়না বেলা বিস্কুট। এখনো মাটির তন্দুরে বানানো হয়। তন্দুরে বানালে বিস্কুটের আসল স্বাদ ও গুণগত মান বজায় থাকে।
বিস্কুট তৈরির প্রস্তুতি পর্বেও তারা পুরনো ধারাকেই অনুসরণ করে থাকেন। ময়দা, চিনি, তেল, ডিম ইত্যাদি দিয়ে বিস্কুটের খামি তৈরি। বিস্কুটকে ফোলানো বা ফাঁপানোর জন্য অন্যরা যেখানে ‘ইস্ট’ বা খাওয়ার সোডা ব্যবহার করে, সেখানে বেলা বিস্কুট তৈরির সময় ‘মাওয়া’ মেশানো হয়ে থাকে। স্বাস্থ্যের জন্য এটি একটি ভালো পদ্ধতি। যাদের গ্যাস্ট্রিক বা অ্যাসিডিটির সমস্যা আছে তাদের খাওয়ার সোডা বা ইস্ট মিশ্রিত যে কোনো খাদ্য না খাওয়াই ভালো। তাতে অ্যাসিডিটি বেড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। খামি তৈরির পর, খামিকে বিস্কুটের সাইজে কেটে কেটে তা ফাঁপানোর জন্য ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা স্বাভাবিক তাপমাত্রায় রেখে দেয়া হয়। অতঃপর কাঁচা বিস্কুট তন্দুরির ভেতর ঢুকিয়ে প্রথমে এক সাইড ছাঁকা হয় এবং তারপর উপর সাইড ছাঁকে বিস্কুট তৈরির কাজ সম্পন্ন করে। বেলা বিস্কুট আজও তার রূপ গুণকে ধরে রেখেছে ঠিক আগের মতোই। কারণ তাকে ভালোবাসার মানুষ যে বাংলায় অগণিত।
সম্পাদনা – অনন্যা করণ
Discussion about this post