বাংলা ও বাঙালি এই দু’টি শব্দ যখন জোড়শব্দ হয়ে দাঁড়ায় তখন এর সঙ্গে সমার্থক শব্দরূপে যুক্ত হয় বাঙালির প্রিয় দুর্গাপুজো। দুর্গাপুজো পালনের ক্ষেত্রে মহানগরী কলকাতা সকল পুজোপ্রেমিকের নয়নের মণি হয়ে দাঁড়িয়েছে। যত সময় এগোচ্ছে এই পুজো তত তার রঙের প্রকাশ ঘটাচ্ছে। এখনও কলকাতায় বেশ কিছু বনেদি বাড়ি রয়েছে যেখানে দুর্গাপুজো প্রায় ২০০ বছর কিংবা তার থেকেও বেশি পুরানো। আভিজাত্য অহংকারে, সাবেকিয়ানার গরিমায় এই সমস্ত বনেদি বাড়ির পুজোগুলো হয়ে উঠেছে প্রাচীন সভ্যতার এক একটি নিদর্শন। কলকাতা আমাদের আবেগ । বনেদি বাড়ির গুলো দালান জুড়ে রয়েছে বাংলার নানা মুহূর্তের ইতিহাস। যে ইতিহাস আমাদের মুগ্ধ করে। আবেগ তাড়িত করে। আজ যেমন রয়েছে বিডন স্ট্রিটের দর্জি পাড়ায় মিত্র বাড়ির পুজোর কথা। এই বাড়ির পুজোর ইতিহাস বেশ আকর্ষণীয়।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে মহারাজা আদিসুর কনৌজ থেকে পাঁচজন ব্রাহ্মণ ও পাঁচজন কায়স্থকে নিয়ে আসেন। সেই পাঁচ জনের মধ্যে একজন ছিলেন এই বংশের আদি পুরুষ, যাঁর নাম কালিদাস মিত্র। তাঁরই সপ্তদশ প্রজন্ম নরসিংহ মিত্র করগোবিন্দপুর থেকে এসে জঙ্গল কেটে ভবানীপুরে বসতি স্থাপন করেন। ১৮৯২ সালে এই পরিবারের এক সদস্য সুভাষচন্দ্র মিত্র ১৩ নম্বর পদ্মপুকুর রোডে একটি বাড়ি নির্মাণ করেন। তারপর তিনি এই দুর্গাপুজোর প্রথম প্রচলন করেন। এরপর এই বাড়ির পুজোর আচার আর রীতি নীতিও বেশ ঐতিহ্যপূর্ণ আর সাবেকিয়ানায় পরিপূর্ণ। এই বাড়ির একজন সদস্য প্রথমে দেবী মায়ের স্বপ্নাদেশ পান এবং তারপর থেকেই এই পুজো শুরু হয়।
এরপর থেকে দেবীমুর্তির ১০টি হাত তৈরী করা হলেও আটটি হাত চুল দিয়ে ঢেকে রাখা হয় এবং যে দুটি হাতে বালা পড়ানো হয় সেই দুটি হাত উন্মুক্ত করা হয়। জানা যায়, পরিবারের রীতি অনুযায়ী কাঠামো কখনোই বিসর্জন দেওয়া হয় না। মায়ের বাহন সিংহের আকৃতি পৌরাণিক ঘোটকের মতো। কন্যারূপে দেবীকে পূজা করা হয়।ঠাকুরদালানে নবপত্রিকা স্নান করানো হয়। নবপত্রিকা স্নানের সময় বাড়ির মহিলারা তাকে কাপড় দিয়ে ঢেকে রাখেন। সরস্বতী লক্ষ্মী দেবীর কোনও বাহন থাকে না। অতীতে প্রতিপদে দেবীর বোধন হয়ে থাকলেও, বর্তমানে পঞ্চমীতে দেবীর বোধন হয়। এই বাড়ির পুজোর বিশেষ আকর্ষণ হল অষ্টমীতে করা হয় কুমারী পুজো, নবমীতে সধবা পুজো এবং দশমীতে অনুষ্ঠিত হয় অপরাজিতা পুজো। আগে এই বাড়িতে পুজোর সময় যাত্রাগান করতে অহীন্দ্র চৌধুরী, নরেশ মিত্র প্রমুখ ব্যক্তিবর্গরা আসতেন।
সাবেকি ঘরানার এই বনেদি বাড়ির পুজোর আরেকটা লক্ষণীয় বিষয় বিসর্জনের আগে গৃহকর্ত্রী তার মাথার চুল প্রতিমার পায়ে বেঁধে দেন। কারণ তাদের মতে আগামী বছরও যাতে দেবীমা এই গৃহে আসেন, সেই জন্য তাঁকে এই ভাবে বাধা হয়। আসলে অতীতের ইতিহাস আর সাবেকিয়ানার সংস্কারকে অনেক বনেদি পরিবার আজকের যুগে পাল্টে ফেলেছে। কিন্তু দেবীর আরাধনার অতীত ঐতিহ্যকে সহজে মুছে ফেলতে পারে নি। জীবন থেকে আনন্দকে খুঁজতে গিয়ে থিম পুজো, প্রতিযোগিতা, এত কিছুর আড়ালে বনেদি বাড়ির পুজো সত্যি কি ঢাকা পড়ে যায়? না। আলোর ঝলকানি বাদে বাদ্যের মুখর কলরবে অন্তর থেকে মাতৃ আরাধনার নিষ্ঠাটাই প্রাধান্য পায় বনেদি বাড়ির পুজোয়। পারিবারিক মেলবন্ধন যৌথ পরিবারের ধারণাটা কিছুটা হলেও টিমটিমে প্রদীপের শিখার মতো জ্বালিয়ে রাখে। সেটাই বা কম কী?
চিত্র ঋণ – শুভদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়
Discussion about this post