“কান্ডারী! তব সম্মুখে ঐ পলাশীর প্রান্তর, বাঙালীর খুনে লাল হল যেথা ক্লাইভের খঞ্জর! ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায়, ভারতের দিবাকর! উদিবে সে রবি আমাদেরি খুনে রাঙিয়া পূনর্বার।” বাংলা তথা ভারতের ইতিহাসের এক নতুন অধ্যায় লেখা হয়েছিল ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন। হ্যাঁ, ইতিহাসের বাঁক ঘুরেছিল ২৬৩ বছর আগে ঠিক আজকের দিনেই। বাংলা-বিহার-উড়িষ্যা তথা সারা ভারতবর্ষের আকাশে ব্রিটিশ সূর্যোদয়ের সূচনা হয়েছিল সেই দিন। পলাশীর রক্তাক্ত প্রান্তরে ইংরেজদের হাতে নিহত হন বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলা। ভেঙে গুঁড়িয়ে যায় বাংলার শিরদাঁড়া। তবে পলাশীর যুদ্ধ নিছক ইংরেজদের সঙ্গে বাংলার নবাবের যুদ্ধ ছিল না। এর পিছনে ছিল এক গভীর ষড়যন্ত্র। যাতে মদত যুগিয়েছিল এই বাংলারই কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষ। প্রতি বছর ২৩শে জুন আসে এবং বছরের অন্যান্য দিনগুলির মত নিঃশব্দেই চলে যায়। বইয়ের পাতায় চাপা পড়া নিছক ইতিহাসের কিছু অধ্যায় হয়েই থেকে গেছে দিনটি। অথচ এই বিশেষ দিনটির হাত ধরেই বাংলা তথা ভারতবর্ষে ব্রিটিশ পতাকা মাথা তুলে দাঁড়ানোর সাহস পেয়েছিল।
পৃথিবীর অন্যতম প্রাচীন সভ্যতার ধারক ভারতবর্ষ। ভারতবর্ষের ঐশ্বরিক প্রাচুর্যের লোভে বাণিজ্যের বাহানায় লন্ডনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি স্থাপিত করে ব্রিটিশরা। ১৬৯৬ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি সুতানটিতে ফোর্ট উইলিয়াম দূর্গ স্থাপন করতে সচেষ্ট হয়। উদ্দেশ্য একটাই, এদেশে তাদের আধিপত্য বিস্তার। ঠিক সেসময়ই ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভের প্রতি অভিযোগ ওঠে তহবিল তছরুপের। রাজবল্লভের ছেলে কৃষ্ণবল্লভ প্রচুর সোনা এবং টাকা চুরি করে এসে আশ্রয় নেয় ব্রিটিশদের দুর্গে। তৎকালীন নবাব আলিবর্দি খাঁ, কৃষ্ণবল্লভকে প্রত্যাবর্তন করানোর জন্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির গভর্নর ড্রেক সাহেবেকে নির্দেশ দেন। কিন্তু সেই নির্দেশ অমান্য করেন তিনি। ১৭৫৬ সালের ৯ এপ্রিল বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার রক্ষক হিসাবে মসনদে বসেন নবাব সিরাজউদ্দৌলা। সিংহাসনে বসে প্রথমেই তিনি ব্রিটিশদের দুর্গ তৈরির কাজ স্থগিত রাখার নির্দেশ দেন। এছাড়াও কৃষ্ণবল্লভকে নবাবের হাতে তুলে দেওয়ার ফরমানও জারি করেন তিনি। ফলে ইংরেজদের সঙ্গে সংঘাত শুরু হয় তাঁর।
নবাবের বিরুদ্ধে ইংরেজদের আক্রোশে ইন্ধন জোগান নবাবেরই সেনাপতি মীরজাফর। বাংলার সিংহাসন লাভের স্বপ্নে বিভোর হয়ে ব্রিটিশদের সাধ্যমত সহায়তা করতে লাগলেন তিনি। ১৭৫৭ সালের ২৩ এপ্রিল নবাবকে সিংহাসনচ্যুত করার পক্ষে প্রস্তাব পাস করে ব্রিটিশ কলকাতা পরিষদ। প্রস্তাব কার্যকর করতে ইংরেজ সেনাপতি লর্ড ক্লাইভ রাজদরবারের এক বিশ্বস্ত সদস্য উমি চাঁদকে নিযুক্ত করেন। তবে মূল ষড়যন্ত্রের নেপথ্যে যে ছিলেন মীরজাফর তা টের পেয়ে, প্রধান সেনাপতির পদ থেকে তাকে অপসারণ করেন নবাব। কূটবুদ্ধিধারী মীরজাফর এরপর নবাবের বিশ্বাস ভাজন হয়ে ওঠতে কোরান ছুঁয়ে শপথ গ্রহণ করে। খুশি হয়ে মীর জাফরকে পুনর্বহাল করেন নবাব। এরপরই আসে সেই কালো দিন। ইতিহাসের পাতায় লেখা হয় পলাশী প্রান্তরের রক্তাক্ত ইতিহাস।
“হায় পলাশী! এঁকে দিলি তুই জননীর বুকে কলঙ্ক-কালিমা রাশি, পলাশী, হায় পলাশী॥ আত্মঘাতী স্বজাতি মাখিয়া রুধির কুমকুম, তোরই প্রান্তরে ফুটে ঝরে গেল পলাশ কুসুম। তোরই গঙ্গার তীরে পলাশ-সঙ্কাশ সূয ওঠে যেন দিগন্ত উদ্ভাসি’॥” ২৩ জুন সেনাপতি ক্লাইভের নেতৃত্বে ব্রিটিশ বাহিনী ভাগীরথী নদী পার করে পলাশীর এক প্রান্তে শিবির স্থাপন করে। পলাশীর ‘লক্ষবাগ’ আমবাগানে ব্রিটিশ সৈন্যদল তাদের সমাবেশ বসিয়েছিল। আমবাগানের চারপাশের মাটির বাঁধ ব্রিটিশ বাহিনীকে বাড়তি সুবিধাও দিয়েছিল। এই যুদ্ধে নবাবের পক্ষে পঞ্চাশ হাজার সৈন্যের এক বিশাল বাহিনী মজুত ছিল। অপরদিকে ব্রিটিশ সৈন্যদলের সংখ্যা ছিল মাত্র তিন হাজার। কিন্তু আস্তিনের মধ্যেই লুকিয়ে ছিল সাপ! নবাবের দিকে সৈন্যদলের মধ্যে প্রায় চল্লিশ হাজার সৈন্যই ছিল বিশ্বাসঘাতকের দলে। যুদ্ধে মীর মদন ও মোহনলাল সহ আরও বেশ কয়েকজন নিজের নবাবের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। যুদ্ধের শুরুতেই ব্রিটিশ বাহিনীকে প্রায় কোণঠাসা করে ফেলেন মীরমদন। ব্রিটিশ সৈন্যের দল বোধহয় এতটা প্রতিরোধ আশা করতে পারেনি। এর মধ্যেই পুরোদমে চলতে থাকে যুদ্ধ।
ঠিক দুপুর নাগাদ আকাশে ঘনায় কালো মেঘের ছায়া। শুরু হল তুমুল বৃষ্টি। ব্রিটিশ বাহিনী অত্যন্ত তৎপরতার সঙ্গে নিজেদের কামান ও গোলা-বারুদ ঢেকে ফেললেও, নিজেদের গোলাবারুদ ঢাকতে ব্যর্থ হয় নবাবের সৈন্যবাহিনী। যার ফলে বৃষ্টিতে ভিজে সেগুলি অব্যবহার্য হয়ে যায়। এই আকস্মিক বিপর্যয়ের পরও মীরমদন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে থাকেন। তাঁর সাথে প্রাণপণে যুদ্ধ চালিয়ে যান মোহনলাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নয়ে সিং হাজারী ও ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রের অধীনে থাকা সৈন্যদল।
ঠিক এইরকম এক পরিস্থিতিতেই ঘটে সেই দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা! বেলা তখন প্রায় ৩টে। হঠাৎ ব্রিটিশ সৈন্যদের একটি কামানের গোলা এসে আঘাত করে মীর মদনের বুকে। সঙ্গে সঙ্গেই মাটিতে লুটিয়ে পড়েন তিনি। তাকে তৎক্ষণাৎ নিয়ে আসা হয় নবাবের তাঁবুতে। কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যান তিনি। মীর মদনের অকস্মাৎ মৃত্যু নবাবকে হতভম্ব করে দেয়। তিনি তখন মীরজাফরকে ডেকে পাঠান। মীরজাফর নবাবকে যুদ্ধ বন্ধ করার উপদেশ দেন। তাঁর কথায় প্ররোচিত হয়ে নবাব যুদ্ধ বন্ধ করার জন্য মোহনলালকে নির্দেশ পাঠান। তিনি না ফিরে আসতে চাইলে বারবার যুদ্ধ থামিয়ে শিবিরে ফিরে আসতে বলা হয় তাঁকে। ক্ষোভে, অভিমানে যুদ্ধক্ষেত্র ত্যাগ করেন তিনি। নবাব নিজেও পরাজয় স্বীকার করে ফিরে যান মুর্শিদাবাদের পথে। ঠিক এই সময়ে ক্লাইভ আক্রমণ করেন নবাবের নেতৃত্বহীন বিক্ষিপ্ত সৈন্যবাহিনীকে। ফলে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েন তারা। ফরাসি সেনানায়ক সিনফ্রে যুদ্ধ চালানোর চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। প্রায় মুহূর্তের মধ্যেই পাল্টে যায় যুদ্ধের গতি। বিজয়ী হয় ব্রিটিশ সেনার দল।
এরপর বীরদর্পে মুর্শিদাবাদের দিকে রওনা দেন ক্লাইভ। আসলে পলাশীর যুদ্ধ নিছক যুদ্ধ ছিল না কোনও দিনই। চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের মিশেলে এক সুন্দর প্রহসন ছিল এটি। ইতিহাসের পাতায় এক কলঙ্কময় অধ্যায় হিসাবেই চিরদিন লেখা থাকবে পলাশীর যুদ্ধের নাম। ঠিক যে সময় থেকেই বাংলা তথা ভারতের আকাশে ব্রিটিশ সূর্যোদয়ের সূচনা ঘটেছিল!
(উদ্ধৃত অংশগুলি কাজী নজরুল ইসলাম রচিত কবিতার অংশ বিশেষ)
Discussion about this post