সিনেমা থিয়েটার ভালোবাসে না এমন মানুষ আজকের দিনে বিরল। তবে বর্তমান প্রজন্মের কাছে সিনেমা হল বলতেই মাল্টিপ্লেক্স, আইনক্স কিংবা সিনেপোলিসই থাকে প্রথম সারিতে। যদিও প্রকৃত সিনেমা বা থিয়েটার প্রেমী মানুষদের কাছে পুরনো কলকাতার বহু প্রেক্ষাগৃহ আজও বেঁচে পছন্দের লিস্টিতে। এমন বহু প্রেক্ষাগৃহের মধ্যে আজ একটু বলা যাক সেই প্রেক্ষাগৃহকে নিয়ে, যেটির পথচলা স্বাধীনতার সময় থেকে। ঠিকানা- ১০২, এস.পি.মুখার্জী রোড, কালীঘাট, কলকাতা-২৬। মুখে বললে হাজরা ক্রসিংয়ের কাছের পুরনো সিনেমা হল। এতক্ষণে নিশ্চয়ই ঠাহর করে নিয়েছেন যে কোন প্রেক্ষাগৃহ! আজ্ঞে হ্যাঁ, বসুশ্রী সিনেমা হল নিয়েই আজকের এই আলোচনা।
একসময়ের দক্ষিণ কলকাতার মূল আকর্ষণ ছিল এই প্রেক্ষাগৃহ। শুধু প্রেক্ষাগৃহ হিসাবে নয় বরং কলকাতার দর্শনীয় স্থানের মধ্যে নাম থাকতো এটির। ভাবলে অবাক হবেন যে এই বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহই প্রথম হেরিটেজ সিনেমা হল যা নন্দনেরও আগে জন্ম নেয়। তখনকার সময়ে এই প্রেক্ষাগৃহ কে হেরিটেজ তকমা দেয় ফ্রেঞ্চ কংসলেট। তখন এই প্রেক্ষাগৃহেই প্রতি রবিবার ফ্রেঞ্চ কংসলেট আর অলিয়ান্স ফ্রঁসে দু বেঙ্গলের মিলিত প্রচেষ্টায় ফরাসী সিনেমা দেখানো হতো। তখন যে কোনও ফরাসী চলচ্চিত্র এবং পরিচালকদের নিয়ে আলোচনা তর্ক-বিতর্ক সভা সবটাই এই প্রেক্ষাগৃহে হতো। গোটা মহানগরীর মধ্যে একমাত্র এখানেই প্রায় সব সিনেমার প্রিমিয়ার হতো।
সালটা ১৯৫৫, ‘পথের পাঁচালী’র প্রিমিয়ার হয় এই বসুশ্রীতেই। সত্যজিৎ রায়ের সঙ্গে এই প্রেক্ষাগৃহের বাঁধনটা এমনই হয়ে যায় যে তার ঠিক ২ বছর বাদেই ১৯৫৭ সালে ‘অযান্ত্রিক’-এর প্রিমিয়ারও হয় এখানেই। এখানে নববর্ষের জলসা ছিল এক সময়ের কলকাতার শ্রেষ্ঠ আকর্ষণ। কতো না তারকার সমাবেশ হতো সেখানে। ঋত্বিক ঘটক, মৃণাল সেন, ঋষিকেশ মুখার্জী, সলিল চৌধুরী ছাড়াও আরও অনেকের নিয়মিত আড্ডা ছিল এই বসুশ্রী প্রেক্ষাগৃহের কফি হাউসে। সেই সময়ের হিট জুটি উত্তম- সুচিত্রার এভারগ্রিন সিনেমারগুলির প্রিমিয়ারও হয়েছিল একসময় এই প্রেক্ষাগৃহেই।
ভাবতেই কেমন অবাক লাগে যে ,আজ যেটি শুধুই একটা পুরনো প্রেক্ষাগৃহ এক সময় সেটিই ছিল সম্পূর্ণ সিনেমা জগতের প্রাণ। সেই চারের দশক থেকেই বসুশ্রীর তরফে প্রকাশিত হত পাক্ষিক নিউজ লেটার। তবে আজ তা অতীত। প্রযুক্তির উন্নতির সঙ্গে নতুনের স্রোতে এমনিতেই সঙ্গীন অবস্থা প্রেক্ষাগৃহের। অতিমারীর কবলে সমগ্র পৃথিবীর অবস্থাই শোচনীয় আর টিমটিম করে চলতে থাকা এই সিঙ্গল স্ক্রিনের অবস্থা বেশ খারাপের দিকেই। এভাবে চলতে থাকলে খুব শীঘ্রই কালের স্রোতে হার মেনে বিলীন হয়ে যাবে বহু নস্টালজিক স্মৃতিতে ঘেরা এই প্রেক্ষাগৃহ। তলিয়ে যাবে সিনেমা জগতের এক মাইলস্টোন ঐতিহ্য যা বহুকাল থেকে বুকে আঁকড়ে রেখেছে এই বসুশ্রী।
চিত্র ঋণ – দেবরঞ্জন শীল, অরুণ রায়চৌধুরী, বসুশ্রী সিনেমা ফেসবুক পেজ
Discussion about this post