অনেকটা বনরুটির মতো দেখতে, কিন্তু মাছ, পাতা, ফুল বা অন্য কিছুর নকশা করা। পুরান ঢাকায় পরপর সমস্ত দোকানে সাজানো রয়েছে বরাতি রুটি বা ফেন্সি রুটি। নকশা রুটি পিঠা হিসেবেও অনেকের কাছে এই রুটি পরিচিত। তবে পুরান ঢাকার এ দৃশ্য সবসময়ের নয়। শবে বরাতের আগের দিন থেকে পরের দু-তিনদিন বিভিন্ন দোকানে এই রুটি দেখা যায়। অনেকেই শবে বরাত উপলক্ষ্যে ফুটপাতে সামিয়ানা খাটিয়ে বিক্রি করেন এই রুটি আর বিভিন্ন ধরনের হালুয়া।
দুই বারের ঈদের পর ইসলাম ধর্মের আরেকটি বড় উৎসব হলো শবে বরাত। মুসলিমদের বিশ্বাস এই রাতের ওপর নির্ভর করে আগামী বছরটা কেমন যাবে। এদিন দান করলেও সওয়াব (পুণ্য) হয়। মূলতঃ তার জন্যই শবে বরাতে রুটি হালুয়া বানানোর প্রচলন শুরু হয়। পুরান ঢাকার শাহী মসজিদকে ঘিরেই সেসময় বিভিন্ন প্রথা গড়ে ওঠে। ঢাকাইয়া অন্যান্য প্রথার মতো এই প্রথাও মুঘলদের থেকেই এসেছে। খাজা মঈনুদ্দিন চিশতিয়া যখন এই উপমহাদেশে আসেন সে সময় উৎসবে গরিবদের ভিক্ষে দেওয়া হতো না। সেটার পরিবর্তে রুটি হালুয়া বিতরণ করা হতো। সেই থেকেই নিকট আত্মীয় স্বজনদের বাড়িতেও এসব পাঠানোর রীতি চলে আসছে। নব বিবাহতা ছেলে মেয়েদের শ্বশুরবাড়িতেও আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন জামকাপড় সহ এসব রুটি হালুয়া পাঠানোর রীতিও সেই নবাবি আমল থেকেই চলে আসছে।
কথিত আছে ঢাকার কোনো নবাব শবে বরাতের আগে তার একমাত্র মেয়ের শ্বশুর বাড়িতে সাধারণ রুটি হালুয়ার পরিবর্তে একটু ভিন্নধর্মী সুস্বাদু রুটি জাতীয় কিছু পাঠাতে চেয়েছিলেন। যা অন্যান্য রুটির থেকে ভিন্ন দেখতে হবে এবং স্বাদে গন্ধে হবে অতুলনীয়। ততদিনে উপমহাদেশে ব্রিটিশদের আগমন হয়ে গেছে। সে জন্যও সেই সময়েই এই রুটিকে ফেন্সি রুটি বলা হতো। নবাবের খাস হালুয়াই ব্রিটিশদের পাউরুটি তৈরির ধরন জানতেন। তিনিই নবাবের আদেশে প্রথমবার এই বরাতি রুটি তৈরি করেন। শবে বরাতের জন্য তৈরি করা হয়েছিল বলে এই রুটির নাম হয় বরাতি রুটি। হালুয়াই ময়দার সাথে দুধ, ডিম, ঘি, সাদা তিল, কিসমিস, কাজুবাদাম, মোরব্বা মিশিয়ে এই রুটি তৈরি করেন। বিভিন্ন প্রাণীর আকৃতিতে বানানো এই রুটির সাথে পাঠানো হয় বিভিন্ন ধরনের হালুয়া এবং হরেক রকমের মিষ্টি। সাথে ডালায় সাজিয়ে পাঠানো হয় নতুন পোশাক। ইদানিং এই রুটিকে মার্বেল, কাঁচ, আয়না দিয়ে আরও বাহারি ভাবে সাজানো হয়। সেই থেকেই এই রুটির চল পুরান ঢাকার চক বাজার সহ বিভিন্ন এলাকায় শুরু হয়। এখনো বংশ পরম্পরায় এই রুটির ব্যবসা করে আসছেন এলাকার বিভিন্ন ব্যবসায়ী।
পুরান ঢাকার এক আদি বাসিন্দা জানান আগে শুধু এই রুটি আর হালুয়াই পাঠানো হতো না। সাথে থাকতো গোটা মুরগি, বিভিন্ন ধরনের কাবাব, পরোটা আর মাংসের বিভিন্ন পদ। কালের পরিবর্তে এসব ঐতিহ্য বিলুপ্ত হয়েছে। ইদানিং অনেকেই একটু স্বাস্থ্য সচেতন হওয়ায় কমেছে এসবের বেচাকেনা। অনেকে আবার শবে বরাতের দিন রুটি হালুয়ার পরিবর্তে বিরিয়ানি বা পোলাও করেন। আর নিত্য ব্যস্ত দিনে ঐতিহ্য ধরে রাখার সময়ই বা কজনের আছে?
Discussion about this post