‘বালুচরী’ শব্দটা শুনলেই মাথায় প্রথম কীসের প্রসঙ্গ আসে? নিশ্চয়ই নবাবি আমলে রেশম সুতোয় বোনা পশ্চিমবঙ্গের প্রসিদ্ধ নিখুঁত কারুকার্যের বালুচরী শাড়ির, কি তাই তো? হ্যাঁ অধিকাংশ মানুষের কাছেই তাই। কিন্তু ‘বালুচরী’র পরের অক্ষরটা শাড়ি না বসিয়ে যদি কোনো মিষ্টির নাম বসানো হয় তাহলে কি সেটা খানিকটা অপ্রাসঙ্গিক হবে? আজ্ঞে না মশাই, একেবারেই নয়। মিষ্টিটা হল আমাদের প্রায় সবারই কম বেশি প্রিয় মালপোয়া। বাঙালিদের কাছে তো এই মিষ্টিকে বিশিষ্ট অভিনেতা ভানু বন্দ্যোপাধ্যায় আরও জনপ্রিয় করে দিয়েছেন। সাড়ে চুয়াত্তর ছবির সেই বিখ্যাত সংলাপ “মাসিমা মালপো খামু” আজও বাঙালির মনে বেশ ঝরঝরে। যাই হোক, এই মালপোয়া হল মুর্শিদাবাদের জিয়াগঞ্জের এক ঐতিহ্যবাহী মিষ্টি। কিন্তু ‘বালুচরী মালপোয়া’ নামকরণের কারণ? ক্রমশ প্রকাশ্য!
মুর্শিদাবাদ শহর থেকে গঙ্গার ধার দিয়ে জিয়াগঞ্জ মাত্র মিনিট দশ পনেরো মিনিটের পথ। মুর্শিদাবাদের বেশ পুরনো শহর। এখানকার মালপোয়াও বহু পুরনো এবং বেশ বিখ্যাতও বটে। এক সময় জিয়াগঞ্জের নাম ছিল বালুচর। তাই এখানকার মালপোয়ার পোশাকি নাম হয়ে উঠেছিল ‘বালুচরী মালপোয়া’। যেমন নবাবি আমলে বালুচরের তাঁতিদের তৈরি কাপড় এখন বালুচরী শাড়ি নামেই অধিক প্রসিদ্ধ। তবে এই মালপোয়ার পুরনো নামের কিন্তু প্রচলন আর নেই।
জিয়াগঞ্জের মালপোয়া দেখে কিন্তু আপনার প্রথমে বিশ্বাস করতে একটু অসুবিধা হতে পারে যে সত্যিই এটা মালপোয়া! আমরা সাধারণত মালপোয়া দেখে অভ্যস্ত চ্যাপ্টা গোলাকার লুচির সাইজে। কিন্তু এখানকার মালপোয়া ঠিক রাজভোগের আকারের একটি চ্যাপ্টা লালচে মিষ্টি। ভিতরের কড়া পাকের মশলার পুরটি মিষ্টি স্বাদের, সঙ্গে গোলমরিচ ও মৌরির স্বাদও মিলেমিশে অদ্ভুত এক অনন্য স্বাদের সৃষ্টি করেছে। এমন কড়া পাকের মিষ্টিও যে ময়রার নিখুঁত হাতের ছোঁয়ায় এমন মুখরোচক হয়ে উঠতে পারে তার একমাত্র নিদর্শন জিয়াগঞ্জের মালপোয়া। সদর ঘাটের কিছুটা আগে নামহীন একটি দোকানে এখনো মেলে এই মিষ্টি। শহরের পুরনো দোকানগুলির মধ্যে অন্যতম প্রায় অর্ধ শতকেরও বেশি পুরনো দোকানটি নারায়ণ ঘোষের মিষ্টির দোকান নামেই এলাকায় বিখ্যাত। দোকানটি আজও পুরনো দিনের সেই ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছে।
একটা সময় ছিল যখন শহরের প্রায় প্রতিটা দোকানেই মিলত এই মিষ্টি। আধুনিকতার রোষে মানুষের রুচি অনেকটাই বদলেছে। তাই হাতে গোনা কয়েকটি দোকানেই এখন পাওয়া যায় এই মালপোয়া। ঐতিহ্যবাহী এই মিষ্টির ঐতিহাসিক গুরুত্ব ও কিছু কম নয়। শোনা যায়, স্থানীয় জৈন সম্প্রদায়ের মানুষ জিয়াগঞ্জের মালপোয়ার খুব কদর করতেন। এমনকি স্থানীয় রাজা জমিদাররাও খুব পছন্দ করতেন এই মিষ্টি। কথিত আছে, নশিপুর রাজবাড়িতেও নাকি নিয়মিত মালপোয়া আসত। সবথেকে উল্লেখযোগ্য, একবার আমাদের সবার প্রিয় নেতাজি জিয়াগঞ্জে সভা করতে আসায় স্থানীয়রা বেশ বড় আকারের একটি মালপোয়া তাঁকে ভালোবাসার উপহার হিসেবে দিয়েছিলেন। শোনা যায় তিনি খেয়ে ধন্য ধন্য করেছিলেন সেই অবর্ণনীয় স্বাদকে।
চিত্র ও তথ্য ঋণ – http://www.jathaichchatathaja.com/
Discussion about this post