কান পাতলেই এখন ভোটের মশলামুড়ি সব খবর। কোন দল কত ভোট পাবে কে কত আসন পাবে এই নিয়ে চিন্তিত অনেকেই। তবে বেশিরভাগ সাধারণ আবার এইসব ব্যাপার থেকে শত হাত দূরে। রোজকার অফিস সংসার খাওয়াদাওয়া পুত্র কন্যা এসব নিয়েই ব্যস্ত। ভোটটা তাদের কাছে দেশের নাগরিকতার একটা কর্তব্য মাত্র। আর হাওয়া যেদিকে বইছে সে দিকে গা ভাসিয়ে নির্বাচনটি সেরে ফেলেন। একটা সময় ছিল যখন ভ্যাপসা গরমে ঘুপচি বুথেই চলত ভোটের কাজ। অন্ধকারের মধ্যে হ্যারিকেন কিংবা মোমবাতির আলো জ্বালিয়ে ভোটের ছাপ পড়ত। লাখ লাখ ভোটার। ছাপ যে কোন দলকে দিতে গিয়ে কোন দল পেত বলা মুশকিল। এই দ্বন্দ্বে প্রচুর ভোটকে বাতিলও করতে হত। আর তাতে সমস্যা হত হিসেবে। তার উপর দলের গুন্ডাগিরি, ছাপ্পা ভোট, ব্যালট ছিনতাই, বোমা পড়া এসব উপরি ঝামেলা। ১৯৮২ এর আগে পর্যন্ত ব্যালট পেপারেই ছাপ পড়ত ভোটের। তারপর অবশ্য ইলেকট্রনিক্স ভোটিং মেশিন অর্থাৎ ই.ভি.এম এসে যায়। সামনে ভোটের এই গরমাগরম পরিস্থিতিতে চলুন না আগেকার দিনের ব্যলট ভোটের সেই মহাকর্মযজ্ঞে একটু সামিল হই।
আলিপুরের ‘ওয়েস্ট বেঙ্গল গভঃ প্রেস’। এখানেই ভোটের ঠিক আগে শুরু হত ব্যলট ছাপার কাজ। প্রেসের ফুটবল মাঠটি জুড়ে বিশাল এক প্যান্ডল বাঁধা হত। নীচে ফেলা হত কাঠের পাটাতন। ২-৩ ফুট উঁচু করেই কাঠ বিছানো হত যাতে বৃষ্টি হলেও জল না ঢোকে। মাঠ ঘেরা হত টিন ও তারের জাল দিয়ে যাতে যে কেউ ঢুকে পড়তে না পারে। জলনিষ্কাশনের পাম্পও বসত। দমকল সবসময় তৈরী থাকত পাশেই দুর্ঘটনা ঘটলেই যাতে হাজির হতে পারে। প্রেসের কর্মীরা এইসময় বাড়তি উপার্জনের মজায় দু’দিন ধরে ওভারটাইম করত। চলত ব্যালট ছাপা নাম্বারিং করা। এরপর প্রতিটা ব্যালটকে খুঁটিয়ে চেকিং। ছাপার ভুল তাই বিশেষ নজরে আসত না। কিন্তু কাগজ ছেঁড়া, কাটা ব্যালট এসবে বেশ ত্রুটি থাকত। এরপর জেলাভাগে আলাদা করা হত পেপারগুলো। এরপরের কাজ ডি.এম, এস.ডিও, এডি.এম ও অফিসের কর্মচারীদের। ভোটের কাগজ গোনা, দেখা, হিসেব নিকেশের পর বড় বড় কালো ট্রাংকে ভরে লরি বোঝাই হত ব্যলট। পুলিশি নজর থাকত সদাসর্বদা। এরপর এগুলিকে সাইজ করে কেটে ভরা হত। ভোট প্রার্থীর নম্বর বসলে তবে গিয়ে এতদিনের এই যজ্ঞের সমাপ্তি হত।
প্রতিটি বুথের জন্য অতিরিক্ত একটি ব্যলট তৈরী থাকত। বুথ দখল হলে কিংবা ছিনতাই হলে ওই অতিরিক্ত ব্যলট কাজে লাগত। ভোট নেওয়া শেষ হলে অতিরিও ব্যালট পুড়িয়ে দেওয়া হত। এত পরিশ্রমের পর আবার শুরু হত গণনা পর্ব। তবে বর্তমানে অনেকটাই সুবিধার সংস্পর্শে এসেছে সবাই। ইভিএম আসার পর ভোটকর্মী এবং সাধারণ এসব থেকে মুক্তি পেয়েছে চিরতরে। তার সঙ্গে বেশ কমেছে গণনার সময়ও। কিন্তু আইন থাকলে তার ফাঁকও থাকে। সময় যত আধুনিক হচ্ছে হাতের কারসাজিও তত শৌখিন হয়েছে। তাই ইভিএমের বিরুদ্ধেও আসছে অভিযোগের কলঙ্ক। অনেকেই দাবি করছেন আবার ব্যালেটে ফেরত যেতে। সুবিধা অসুবিধা জড়িয়ে ব্যালেট যেন কোথাও বাঙালি রক্তের সাথে মিশেই রয়েছে।
Discussion about this post