লালমাটির দেশ পুরুলিয়া। এই পুরুলিয়া আপন সংস্কৃতিতে পূর্ণ। নানাপ্রকার লোকনৃত্য যেমন ছৌ, কাঠি, বুলবুলি, নাচনি, দাসাই এবং বিভিন্ন লোকসঙ্গীত যেমন ঝুমুর, টুসু, ভাদু, বাউল, সোহরায়, বছরভর নানা আনন্দ-বিষাদের উৎসব, পুজো-পার্বণ, পরব এই অঞ্চলের সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত। উদযাপিত হয় বিভিন্ন পরব। সেরকমই এক বহুল পরিচিত পরব ‘ঝুমুর’। যা আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। আমাদের দেশের প্রাচীন লোকসঙ্গীত ‘ঝুমুর’। জানা যায় এই লোকসঙ্গীতের আতুরঘড় ছোটনাগপুর মালভূমি। ঝুমুর হলো- গান, নাচ, তাল ও গায়নশৈলী নিয়ে একটি সাধারণ লোকসঙ্গীতের ধারা। এখন আর ঝুমুর আর আগের ঝুমুর নেই। বিকৃত হচ্ছে ঝুমুর। এই লোকগীতির গায়ে ছাপ পড়ছে নতুন প্রজন্মের গানের। এই প্রসঙ্গে বলা বাহুল্য রতন কাহারের ‘গেন্দাফুল’ গানটি নিয়ে কিছুদিন আগে জলঘোলা হয়েছিল।
ঝুমুর গান কী, তা বলার আগে এই সঙ্গীতের সীমানা নিয়ে কিছু কথা বলা দরকার। সাধারণ মতে, পশ্চিমবঙ্গের পুরুলিয়া, বাঁকুড়া, মেদিনীপুর , বীরভূম, ঝাড়খণ্ডের রাঁচি, সিংভূম, হাজারিবাগ, পালামৌ, গিরিডি, ধানবাদ, বোকারো, সাঁওতাল পরগনা, ওড়িশার ময়ূরভঞ্জ, কেওনঝাড়, সুন্দরগড়, সম্বলপুর অঞ্চলে এই গান প্রচলিত। অঞ্চলভেদে ‘ঝুমুর’ শব্দটির উচ্চারণে রকমফের দেখা যায়। যেমন, আমরা, যারা রাঢ়ী বাংলায় কথা বলি, তাদের কাছে এই উচ্চারণ ‘ঝুমুর’। আবার পুরুলিয়ার আঞ্চলিক উচ্চারণ ‘ঝুমেইর’ বা ‘ঝুমইর’। ওড়িশায় ‘ঝুমুর’ উচ্চারণই প্রচলিত। এছাড়া, কুড়মালি প্রাচীন গীতে ‘ঝুমরি’ শব্দেরও ব্যবহার করা হয়।
ঝুমুর সঙ্গীতশিল্পী হিসেবে একসময় রেলা ছিল যাদের অর্থাৎ ভবপ্রীতা, চামু কর্মকার, পরেশ কর্মকারের ঝুমুর এখন অতীত। তাদের নাম বললে কেউ প্রায় চেনে না এখন তাদের। প্রশ্ন ওঠে তারা কারা? তাই শিল্পী দয়াময় রায় বলেন, ঝুমুরের উৎস, বিবর্তন প্রভৃতি সবকিছু নিয়ে কাজ করবে ‘মানভূম শিল্পী গোষ্ঠী’। আর তাই বিকৃত ঝুমুরকে, তাঁদের এই ‘প্রাণের’ শিল্পকে বাঁচাতে এগিয়ে এলেন পুরুলিয়ার ‘মানভূম শিল্পী গোষ্ঠী’ এবং ঝুমুর গবেষক ও শিল্প অনুরাগীরা। পুরুলিয়ার ‘ঝুমুর সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত কিশোর গুপ্ত ঝুমুরের স্বরলিপি তৈরি করেছেন। এইভাবে চলছে ঝুমুরের সংরক্ষণ প্রচেষ্টা।
দেশের প্রাচীন লোকসঙ্গীত ঝুমুরকে বাঁচাতে এবং সকলের দরবারে পৌঁছে দিতে সিলেবাসে ঠাঁই দিচ্ছে সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়। এই বিষয়ে ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. দীপক রঞ্জন মণ্ডল বলেন, “ঝুমুর ভারতের প্রাচীন লোকসঙ্গীত। সেই সঙ্গীতকে নিয়ে ছাত্র-ছাত্রীরা যাতে লেখাপড়া করতে পারে তাই আমরা চলতি মাস থেকেই ডিপ্লোমা কোর্স চালু করছি।” প্রাচীন এই লোকসঙ্গীতের বিশাল ও বিচিত্র শ্রেণিবিভাগ রয়েছে৷ তবে, ‘টাঁড়’ ঝুমুরই আদি ঝুমুর হিসাবে পরিচিত৷ তাছাড়া এই লোকসঙ্গীতে দরবারি ঝুমুর উল্লেখযোগ্য। লোকসংস্কৃতি গবেষক সুভাষ রায় বলেন, “আমি যত টুকু জানি ঝুমুরকে প্রথম সিধো-কানহো-বিরসা বিশ্ববিদ্যালয়ই তাদের সিলেবাসে জায়গা দেয়।”
বলা বাহুল্য, ঝুমুর শব্দটি মধ্যযুগে প্রচলন ছিল । মধ্যযুগের পদকল্পতরু গ্রন্থের একটি পদে লেখা আছে ” যুবতী যুথ শত গাওত কুমারী”। গোবিন্দ দাসের পদেও পাওয়া যায়। তবে এসব এখন অতীত। এখন ঝুমুর বই বা অন্তর্জালেই সীমাবদ্ধ। এর বাইরে এর বেশি কেউ সেরকম জানেনা। আসলে নেপথ্যে রয়েছে যুগের হাওয়া, মানসিকতার পরিবর্তনের হাওয়া। সাবেকি শিল্পের প্রতি আর আকৃষ্ট নয় বর্তমান প্রজন্ম। এই শিল্পের পরিণতি ধ্বংসেই। আর তাই সময়ের প্রয়োজনে ঝুমুর সংরক্ষণে একজোট হয়েছেন শিল্পী গোষ্ঠী ও ঝুমুর গবেষকরা।
Discussion about this post