শুধু ইলিশের কাবাব আর ফ্রুট কেক নয়, আনন্দ বেকারির সব পদই জনপ্রিয়। বয়স ১১১ বছর পার হয়েছে, তবু তার খাবারের স্বাদে এতটুকু চিড় ধরেনি। এখনো ভোজনবিলাসীরা ছুটে যান সাতরওজার আনন্দ বেকারিতে। আনন্দ কনফেকশনারিতে পাওয়া যায় নানা রকম খাবার। এর মধ্যে আছে চিকেন পিৎজা, প্যাটিস, ক্রিম রোল, টিকিয়া, টানাপরোটা, সমুচা, বিস্কুট। এছাড়াও রয়েছে আস্ত মুরগির কাবাব, মুরগির রোস্ট, আস্ত খাসির কাবাব, সুতিকাবাব, বাকরখানি, পনির, কেক ও লাচ্ছা সেমাই। শবে বরাত, রমজান মাস ও ঈদে থাকে বিশেষ আয়োজন। ইলিশ মাছের কাবাব, আস্ত খাসির কাবাব, সুতি কাবাব, বাকরখানি ও টানা পরোটার জন্য আগেই ফরমায়েশ দিয়ে রাখতে হয়। ইলিশের কাবাবের ফরমায়েশ দিতে হয় তিন-চার দিন আগে।
দেশে তখন ব্রিটিশ শাসন চলছিল। সে সময় ঢাকার অন্যতম প্রাণকেন্দ্র ছিল নর্থব্রুক হল, সাধারণের ভাষায় লালকুঠি। সেখানে মঞ্চনাটক হতো, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতো। সেগুলো ঘিরে শিল্পী–সাহিত্যিকেরা আসতেন, আড্ডা জমত, খাওয়াদাওয়া হতো। সব মিলিয়ে জমজমাট এলাকা। লালকুঠির পাশে এক খাস ইংরেজের বেকারির দোকান, সেখানে কাজ নেন ফরিদপুরের চান মিয়া। অখণ্ড বাংলার রাজনীতিতে তখন পালাবদলের সময়। বঙ্গভঙ্গ হয়েছে। ফলে ঢাকার গুরুত্ব অনেক বেড়ে গেছে। কয়েক বছরের মধ্যে আবার বঙ্গভঙ্গ রদ হয়। এরই মধ্যে এখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে বিদায় নেন ব্রিটিশ বেকারির মালিক। তত দিনে অবশ্য চান মিয়া কাজে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছেন, হাতে অর্থকড়িও জমেছে কিছু। সেই টাকা দিয়ে আবুল হাসনাত রোডে সংগীতশিল্পী লায়লা আঞ্জুমান বানুর বাবার বাগানবাড়ি কিনে সংসার পেতেছেন।
যেহেতু জীবনভর বেকারির কাজই শিখেছেন। এখানেই থিতু হওয়ার সিদ্ধান্ত নেন চান মিয়া। বাড়ির একপাশেই একটা বেকারি গড়ে তোলেন। সময়টা ১৯১১ সাল। শুধু বেকারি দিয়ে বসলেই তো হলো না, ক্রেতাও থাকা চাই। রুটি–বিস্কুট খাওয়া অভিজাত লোকেরা চলে গেছেন পূর্ব বাংলা ছেড়ে। তাই টিকে থাকার জন্য চান মিয়াকে নামতে হয় অন্য এক যুদ্ধে। সারা রাত ধরে তিনি রুটি ও বিস্কুট বানিয়ে সকালে সেগুলো নিয়ে চলে যেতেন বিভিন্ন হাটে। সাধারণ মানুষই ছিল তাঁর কেক ও বিস্কুটের ক্রেতা। শুক্র ও শনিবার জিনজিরায় যান তো রোববার ছোটেন টঙ্গী হাটে। এভাবে সপ্তাহের অন্য দিনগুলোতেও তিনি কোনো না কোনো হাটে রুটি–বিস্কুট বিক্রি করতেন। ঢাকায় তখন বেকারি ছিল হাতে গোনা কয়েকটি। মানুষেরও তখন পর্যন্ত বেকারির তৈরি খাদ্যপণ্য খাওয়ার তেমন অভ্যাস হয়নি। চান মিয়ার নিরন্তর চেষ্টায় ধীরে ধীরে ঢাকার বাসিন্দাদের মধ্যে বেকারি পণ্য জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। গত শতকের পঞ্চাশের দশকে একটি স্থায়ী দোকান খোলেন চান মিয়া। এটির নাম দেন আনন্দ কনফেকশনারি।
‘আনন্দ’ নামটি দেওয়ার পেছনেও আছে এক গল্প। চান মিয়া পদ্মাপারের মানুষ। তাই সংগত কারণেই সুরের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছিল। একই সঙ্গে খুব ধার্মিক ও সঙ্গীতপ্রেমী ছিলেন। সব সময় গুন গুন করে গজল, হামদ, নাত গাইতেন। বেকারির কাজটাও যেন তাঁর কাছে ইবাদতের মতো ছিল। খুব চেষ্টা করতেন সুন্দর কাজ করার। আনন্দময় জীবনের এসব দর্শন থেকেই কনফেকশনারির নাম রাখেন আনন্দ।’ ’৬৯ সালের গণ–অভ্যুত্থানের উত্তাল সময়ে মারা যান চান মিয়া। তাঁর ছেলে তারা মিয়া এ ধাক্কা সামলাতে সামলাতেই চলে আসে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ। ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সেনাদের তাণ্ডবে শহর ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয় তাঁর পরিবার। যুদ্ধ চলাকালেই ফিরে এসে বেকারি চালুর সিদ্ধান্ত নেন তারা মিয়া দ্বিতীয় প্রজন্ম হিসেবে তিনি যখন ব্যবসার হাল ধরলেন, তখনো উত্তাল ছিল দেশের রাজনৈতিক অবস্থা। তবে এর মধ্যেও আনন্দ যে খুব খারাপ চলছিল এমন নয়।
যুদ্ধ শেষে অর্থাৎ সদ্য স্বাধীন দেশের সঙ্গে আনন্দ বেকারিও নতুনভাবে যাত্রা শুরু করে। তারা মিয়া তাঁর ছেলেদের সঙ্গে নিয়ে ব্যবসার হাল ধরেন। আবুল হাসনাত রোডের পর ১৯৮৭ সালে চকবাজারে খোলেন দ্বিতীয় শাখা। এরপর ’৯০–তে পুরান ঢাকা থেকে বের হয়ে নতুন ঢাকার (মহাখালী) শাহীন কমপ্লেক্সে আরেকটি। সর্বশেষ ২০১২ সালে পুরান ঢাকার ওয়ারীতে চালু করা হয় চতুর্থ শাখাটি। সব মিলিয়ে চারটি শাখা নিয়েই চলছে আনন্দ কনফেকশনারির কার্যক্রম। এ কার্যক্রম শুধু রাজধানীকেন্দ্রিক। এখন রাষ্ট্রীয় অনেক অনুষ্ঠানে খাবার যায় আনন্দ থেকে। এমনকি তাঁরাও নিমন্ত্রণ পান অনুষ্ঠানের অতিথি হিসেবে। এভাবেই প্রতিষ্ঠানটি সীমিত পরিসরে কাটিয়ে দিয়েছে ১১১ বছর।
Discussion about this post