৭১ এর বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ ছিল দেশপ্রেমের ইতিহাসে কালজয়ী এবং স্মরণীয় এক ঘটনা। পূর্ব পাকিস্তানে তখন অমাবস্যার ঘোর রাত্রি। অজস্র বাঙালি তখন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর বন্দুকের নলের সামনে নস্যি! অপারেশন সার্চলাইটে হত্যা করা হয়েছে হাজার হাজার নিরস্ত্র বাঙালিকে। কিন্তু টের পাচ্ছে না অন্য সমস্ত দেশ কারণ পাকিস্তানের সংবাদমাধ্যমের হাত পা তখন বাঁধা। ধুরন্ধর ব্যক্তিত্ব ইয়াহিয়া খানের নির্দেশে কিছু সাজানো খবর প্রকাশিত হয়েছিল বটে যাতে কোনরকম সন্দেহ না হয়। কিন্তু ১৩ই জুন লন্ডনে সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল বিশ্বে আলোড়ন ফেলে দেওয়া একটি খবর যা একেবারেই কোনো সাজানো খবর নয়। কীভাবে পাকিস্তানিরা দেশটাকে মৃত্যুপুরী করে তুলছিল তার একটি বাস্তব চিত্র তুলে ধরেছিলেন সাংবাদিক অ্যান্টনি মাসকারেনহাস।
করাচি শহরের অন্যান্য সাংবাদিকদের মতো তাঁর ইয়াহিয়া খান ও সামরিক শাসকদের সঙ্গে যথেষ্ট ভালো সম্পর্ক ছিল। সামরিক সরকারের নির্দেশে তিনি এবং তাঁর আরও ৭ জন সাংবাদিক বন্ধু গেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানে। সেখানে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হত্যালীলার সাক্ষী হয়েছিলেন তাঁরা। আব্দুল বারি নামে বছর ২৪-এর এক যুবক প্রাণ বাঁচাতে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে গিয়ে সেনাবাহিনীর চোখে পড়ে যান। বার বার ক্ষমা চেয়েও প্রাণ দিতে হয়েছিল তাকে। সানডে টাইমসের পাতায় এই দৃশ্যেরই বর্ণনা দিয়েছিলেন মাসকারেনহাস। কিন্তু তাঁদের ওপর নির্দেশ ছিল বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের বিরুদ্ধে খবর ছাপানো। কিন্তু এই দৃশ্যের পর তিনি তাঁর স্ত্রীকে বলেছিলেন, এই সত্যি কথাগুলো লিখতে না পারলে তিনি আর কোনোদিনই কিছু লিখতে পারবেন না।
মনে করা হয়, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে এটিই প্রথম কোনো নিরপেক্ষ সংবাদ প্রতিবেদন। কিন্তু খোদ পাকিস্তানে থেকে তাঁর পক্ষে কখনই সম্ভব ছিল না এমন প্রতিবেদন লিখে প্রকাশ করা। কারণ প্রতিটা খবরই ছিল তখন সেনাবাহিনীর প্রতিনিধিদের নজরদারিতে। তাই মাসকারেনহাস তাঁর আত্মীয়ের অসুস্থতার অজুহাত দিয়ে করাচি ছেড়ে লন্ডনে গিয়েছিলেন। পরে পাক সেনাবাহিনীর চোখ এড়িয়ে তাঁর স্ত্রী এবং পাঁচ সন্তানকেও বের করে আনা হয়েছিল পাকিস্তান থেকে। লন্ডনে সানডে টাইমসের সম্পাদক হ্যারল্ড ইভানস প্রতিবেদনটি শুনে তা প্রকাশে রাজি হন।
আজও এই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনটি ইতিহাস হয়ে রয়ে গিয়েছে। আজও ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধের মিউজিয়ামে সংরক্ষিত আছে সেই ঐতিহাসিক প্রতিবেদনের একটি ছবি। সাংবাদিক মাসকারেনহাস এবং তাঁর পরিবার কখনই আর দেশে ফেরার কথা ভাবেননি। মানিয়ে নিয়েছিলেন নতুন পরিবেশে। তবে ১৯৭১ এ বাংলাদেশের মুক্তি পাওয়াটাই ছিল তাঁদের কাছে সবথেকে বড় পুরষ্কার।
Discussion about this post