সালটা ১৭৫৭, বাংলা তথা ভারতবর্ষের ইতিহাসের এক অনন্য সন্ধিক্ষণের সময়। কবিগুরুর ভাষায় বললে, “বণিকের মানদণ্ড দেখা দিল; পোহালে শর্বরী রাজদণ্ডরূপে।” পলাশীর প্রান্তে রক্তস্নান করে স্বাধীন নবাবী বাংলার সূর্য অস্ত যায়। তবে যুদ্ধ শেষ হলেও পরাজিত নবাব সিরাজউদ্দৌলা হাল ছেড়ে দেননি। বিশ্বাসঘাতক সঙ্গী ও বিদেশি ইংরেজদের থেকে বাঁচতে পলাশী থেকে পূর্ণিয়া পলায়নের পরিকল্পনা ছিল তাঁর। কিন্তু ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতা শকুনের মতন তাঁকে যেনো ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেয়েছিল। সেই ইতিহাসও উত্থাপন করা প্রয়োজন।
২৩ জুন ১৭৫৭, বিকেল ৫টা নাগাদ পলাশীর যুদ্ধে সিরাজের পরাজয় নিশ্চিত হয়ে যায়। নবাব সিরাজউদ্দৌলা এর কিছু আগেই রাজধানীর দিকে দিকে চম্পট দেন। ওইদিনই মধ্যরাতে তিনি মুর্শিদাবাদ পৌঁছেছিলেন। এরপর তিনি একটি সভা তলব করেছিলেন; যেখানে কেউ কেউ তাঁকে দেয় ইংরেজদের কাছে আত্মসমর্পণ করার পরামর্শ, আবার কেউ কেউ দেয় যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার উপদেশ। অপরদিকে সেনাপতি মীরজাফর পরের দিন সিরাজকে ধরতে মুর্শিদাবাদ রওয়ানা দেন। মীরজাফর শহরে আসছেন শুনে গভীর রাতে স্ত্রী লুৎফ-উন-নিসা বেগমের সাথে, তাঁর এক শিশুকন্যাকে বুকে জড়িয়ে নবাব সিরাজ রাজধানী মুর্শিদাবাদ ত্যাগ করলেন।
সিরাজের ইচ্ছে ছিল মালদা দিয়ে পূর্ণিয়ার পথ ধরে পাটনায় পৌঁছে ফরাসী সাহেব জিন ল-এর সাথে দেখা করার। উদ্দেশ্য ছিল ফরাসি সহায়তায় সৈন্য, অর্থ ও রসদ-সামগ্রী সংগ্রহ করে মুর্শিদাবাদ আক্রমণ করে তা পুনর্দখল করা। কিন্তু তাঁর চলার পথে জায়গায় জায়গায় লোকে তাঁকে চিনে ফেলেছে এই সন্দেহে মালদার পথ ছেড়ে রাজমহলের পথ ধরলেন সিরাজ। রাজমহলের কাছাকাছি পৌঁছে খিদে-তেষ্টায় অস্থির সিরাজ এক দরবেশ ফকিরের আস্তানায় গিয়ে নামলেন। বাংলার নবাব রাজমহলের ফকিরের কাছে এক টুকরো রুটি ভিক্ষে চাইলেন। ফকির দানা শাহ সিরাজকে দেখেই চিনতে পেরেছিলেন।
কাকতলীয়ভাবে সিরাজের হুকুমেই কিছুদিন আগে তাঁর নাক-কান কাটা গিয়েছিল। তার ঘা তখনো ভালো করে শুকায়নি। ফকির দানা শাহ সিরাজকে একটু বসতে বলে সোজা চলে গেলেন খবর পাচার করতে। মীরজাফরের জামাতা মীরকাশিম রাজমহলে সিরাজের সন্ধানেই ছিলেন। খবর পেয়েই নিমেষের মধ্যে সৈন্য নিয়ে এসে মীরকাশিম সিরাজউদ্দৌলাকে সপরিবারে বন্দী করে ফেললেন। তারপরের নৃশংস ইতিহাসটা আর নাই বললাম। তবে বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজউদ্দৌলা তাঁর শেষ চেষ্টাটা করেছিলেন। যুদ্ধে জিততে চেয়েছিলেন। বাংলাকে স্বাধীন রাখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু বিশ্বাসঘাতকতা ও বিদেশী কূটনীতির কাছে তাঁকে হার মানতেই হয়েছিলো। গদ্দারির ছুরিকাঘাত যদি তাঁকে না করা হতো, ইতিহাসটা হয়তো অন্যরকম হতো।
Discussion about this post