পৃথিবী তখন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আতঙ্কে তটস্থ। দিনটা ১৯৪৩ এর ২৭ ফেব্রুয়ারী। বার্লিনে তখন হুহু করে ঠান্ডা বাতাস বইছে আর ক্রমাগত তুষারপাত। শান্ত স্থিত এই বার্লিন শহরের একটি অঞ্চলে তখন তীব্র চাঞ্চল্য ছড়িয়ে। দুইহাজার ইহুদী পুরুষকে বিনা দোষে রাস্তা বাড়ি অফিস থেকে জোর করে তুলেছে নাৎসীরা। তারপর ট্রাকে ভরে নিয়ে আসে রোজেনস্ট্রসের এক কমিউনিটি সেন্টারে। না দিয়েছে খাওয়ার, না তেষ্টার জল। এমনকি বাথরুমে যাওয়াও নিষিদ্ধ। উপরমহলের আদেশের অপেক্ষায় হিটলার বাহিনী নজরবন্দী করেছে তাদের। গেস্টাপোর সদস্যরা অধৈর্য্য হয়ে উঠেছে এই বন্দীগুলোকে কখন একটা জবরদস্ত শাস্তি দেওয়া হবে এই আশায়। আসলে ইহুদীদের এরা কোনোদিন মানুষের পর্যায়ে ফেলতে পারেনি। তাই চলত এমন পাশবিক অত্যাচার। কিন্তু এই তথ্যটুকুই কি পর্যাপ্ত নাকি? এদের উদ্ধার পর্ব নিয়ে রয়েছে গোটা এক ইতিহাস। রয়েছে স্ত্রীজাতির শপথ গ্রহণের আলোড়ন। আর সেটিই আপনাদের অবাক করে তুলবে।
হঠাৎ একসাথে উধাও হয়ে যাওয়া বাড়ির পুরুষ ও সন্তানদের চিন্তায় অস্থির বাড়ির মহিলারা। হিটলারের ‘ফ্যাক্টরি অ্যাকশন’ চালু হওয়ার পর থেকেই রাতের ঘুম উড়ে গিয়েছিল এই পরিবারগুলোর। প্রায় ১১ হাজার ইহুদীকে গেস্টাপোরা আগেই অসউইৎজ ক্যাম্পে আটক করেছে। এদের এতদিন ছাড় দিয়েছিল কারণ এদের বাড়ির মহিলারা আর্য জার্মান। কিন্তু শেষ রক্ষা বোধহয় আর হল না। এদেরও আটক করল এবার হিটলারী সেনা। রাস্তায় নামলেন বাড়ির মহিলারা এক এক করে। জড়ো হতে থাকলেন ওই কমিউনিটি সেন্টারের সামনে স্বামী সন্তানদের ভালো মন্দ খবরের আশায়। ওদিকে আবহাওয়াও শীতল থেকে শীতলতর হয়ে পড়ছে। সে সবকে তোয়াক্কা না করেই তীর্থের কাকের মতো খোলা রাস্তায় দাঁড়িয়ে মহিলারা। হাজার অনুরোধের পরও জার্মান সৈন্যরা তাদের কোনো কথা কানেই নিল না। রাগে ক্ষোভে ফেটে পড়ে তারা। শুরু হল প্রতিবাদের স্লোগান। খবর ছড়িয়ে পড়ল দিকে দিকে। মহিলাদের জনবলও উপচে উঠছে ক্রমশ। ভয়ে ক্যাম্পের সামনে কাঁটাতার লাগিয়ে দিল জার্মান বাহিনী। মোতায়েন হল আরও সেনা। মাইকে ঘোষণা চলল রাস্তা খালি না করলে গুলি করতে বাধ্য হবে সেনারা। প্রত্যুত্তরে ‘খুনী খুনী’ করে উঠল নারীকন্ঠের তীব্র চিৎকার।
জার্মান প্রচার মন্ত্রী বুঝলেন পরিস্থিতি এবার হাতের বাইরে চলে যেতে বসেছে। এমনিতেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চক্করে ১০ লক্ষ জার্মান সেনা মারা গিয়েছেন। আবার যদি এই জার্মান মহিলাদের উপর গুলির বৃষ্টি নামে গোটা জার্মান জনতাই ক্ষেপে উঠবে। তাই হুটোপুটি করে বন্দীদের মুক্তি নির্দেশ জারি হল। ১২ মার্চ বাড়ির পুরুষ ও সন্তানদের উদ্ধার করে তবেই থামল প্রতিবাদ। হাসিমুখে বাড়ি ফিরলেন জার্মান রমনীরা। তবে নারীদের সেই তীব্র আন্দোলন জার্মান শাসকদলের মনে যে ভীতির সঞ্চার করেছিল তা বলার আর অপেক্ষা রাখে না। বাড়ির মহিলাদের এমন জয়ের খবর সত্যিই ইতিহাসের এক গৌরবময় অধ্যায়।
Discussion about this post