১৯৭১-এ মুক্তিযুদ্ধ শুরুর সময়। মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীর তখন পাকিস্তানে ১৭৩ নম্বর ইঞ্জিনিয়ারিং ব্যাটেলিয়ানে ‘পাকিস্তান – চীন সংযোগকারী মহাসড়ক’ নির্মাণে তদারকি করছেন। কারাকোরাম থেকে সাত দিনের ছুটি নিয়ে করাচিতে বোনের কাছে এলেন। পাকিদের চক্রান্তের খবর শুনলেন। বুকের ভেতরে ফুঁসে ওঠা আগুন ধামাচাপা দিয়ে সিদ্ধান্ত নিলেন চাকরিতে ইস্তফা দেবেন। পাকিস্তানি সেনা ও সীমান্তরক্ষীদের দৃষ্টি এড়িয়ে শিয়ালকোট সীমান্ত দিয়ে ঢুকলেন ভারতে। সাথে ছিল আরও চারজন বাঙালি অফিসার। প্রথমেই গেলেন নিকটবর্তী বিএসএফের ব্যাটালিয়ন হেড কোয়ার্টারে৷ সেখান থেকে দিল্লি, এরপর কলকাতা।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চারজন বাঙালি সামরিক অফিসার পালিয়ে আসার খবর ছড়িয়ে গেল। মুক্তিযুদ্ধের চিফ কমান্ডার কর্নেল ওসমানী যুদ্ধক্ষেত্র থেকে কলকাতায় এলেন। এই বীরদের অভ্যর্থনা দিলেন৷ ভারত থেকে এবার তিনি বাংলাদেশ সীমান্তে পৌঁছলেন। ৩ জুলাই পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ জেলার মেহেদিপুরে মুক্তিবাহিনীর ৭ নং সেক্টরে সাব সেক্টর কমান্ডার হিসাবে যোগ দেন। একটা পদাতিক প্লাটুন, একটা মর্টার প্লাটুন, এক কোম্পানি ইপিআর আর চার কোম্পানি গণবাহিনীর মুক্তিযোদ্ধা,সাথে কিছু আর্টিলারি আর অন্যান্য সার্ভিস কোরের সদস্য নিয়ে তার বাহিনী। তাদের আক্রমণ ছিল প্রবল ও ত্রাস সৃষ্টিকারী। বিভিন্ন রণাঙ্গনে অসাধারণ কৃতিত্ব দেখানোর কারণে তাঁকে রাজশাহীর চাঁপাইনবাবগঞ্জ শহর দখলের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
১৯৭১ সালের ১০ ডিসেম্বর। আনুমানিক ৫০ জন মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর। চাঁপাইনবাবগঞ্জের পশ্চিমে বারঘরিয়াতে ঘাঁটি নেন। ১১ ডিসেম্বর সেখানে ভারতীয় বাহিনীর গোলন্দাজ বাহিনীর গোলাবর্ষণ করার কথা ছিলো। কিন্তু সেটি হয়নি। পরে ১২ ও ১৩ ডিসেম্বর একাধিকবার ভারতীয় বাহিনীর সঙ্গে যোগাযোগের চেষ্টা করেন। তাতেও ব্যর্থ হন তিনি। কিন্তু ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর দমলেন না। দমল না তার বাঘা বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারাও। তিনি সিদ্ধান্ত নেন ভারতীয় বাহিনীর সহযোগিতা ছাড়াই শত্রুদের অবস্থানে আক্রমণ করবেন। আর তাই করলেন করেন। পাকিস্তানিরা আক্রমণের তোড়ে দ্রুত পালিয়ে শহরের ভেতরে কংক্রিটের দেয়ালের আড়ালে আশ্রয় নিল। ট্রেঞ্চের পর ট্রেঞ্চ দখল করে এগোচ্ছিলেন ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের মুক্তিসেনারা।
যুদ্ধ চলল পরদিন সকাল অবধি। কিন্তু সমস্যা হয়ে দাঁড়ালো একটা পাকা বাড়ির দোতলায় বসানো পাকিস্তানি মেশিনগান। কংক্রিটের দেয়াল ভেদ করে শত্রুকে ঘায়েল করা দুঃসাধ্য হয়ে পড়ল। তার ওপর উঁচু দোতলা থেকে পাকিস্তানি মেশিনগানাররা মুক্তিসেনাদের দূর থেকেই দেখে ফেলছিল। আর বৃষ্টির মতো গুলি চলছিল মুক্তিসেনাদের উপর। মহিউদ্দিনের কপালে দুশ্চিন্তার ভাঁজ পড়ল। কখনো কখনো এক মেশিনগানের কারণেই যুদ্ধের জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়ে যায়। তাই তিনি মরিয়া হয়ে সেই মেশিনগানটা ধ্বংসের পথ খুঁজে চললেন। তাঁর এবিষয়ে অভিজ্ঞতা ছিল বিস্তর। সিদ্ধান্ত নিলেন যেভাবে হোক, গ্রেনেড চার্জ করে পাকিস্তানী ঐ ঘাঁটি উড়িয়ে দিতে হবে। কিন্তু বাঙ্কারের ১০ গজের ভেতর না পৌঁছোলে একাজ সম্ভব নয়। আর গ্রেনেড চার্জ করে জীবিত ফিরে আসার সম্ভাবনা প্রায় শূন্য। এখন প্রশ্ন, কে যাবে এই ‘সুইসাইডাল মিশনে?’ কাকে পাঠাবেন মহিউদ্দিন নিশ্চিত মৃত্যুর মুখে? তাছাড়া আরও গুরুত্বপূর্ণ হলো ঠিকঠাক গ্রেনেডটা ছুড়ে মেশিনগানটিকে ধ্বংস করা।
জয়ের এতটা কাছে এসে হেরে যাওয়ার পাত্র তিনি নন। লম্বা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে তৈরী হলেন নিজেই। বাম হাতে এসএমজি আর ডান হাতে পিন খোলা গ্রেনেড নিয়ে এগিয়ে চললেন। রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ক্ষিপ্রতায় হামা টেনে রাস্তা পেরিয়ে বাড়িটার গোড়ায় চলে এলেন। তারপর চোখের পলকে গ্রেনেডটা ছুড়ে দিলেন মেশিনগান বাঙ্কারের ভেতরে। প্রচণ্ড শব্দে গ্রনেডটা বিস্ফোরিত হলো। তৎক্ষণাৎ পাকিস্তানি মেশিনগানারদের ছিন্নভিন্ন দেহ আছড়ে পড়ল মাটিতে। ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীরের দিকেও ছুটে এল এক পশলা বুলেট-বৃষ্টি। বুলেটের ধাক্কায় ছিটকে লুটিয়ে পড়লেন তিনি। সবুজ ঘাসের ফাঁক গলে চুইয়ে পড়া লাল রক্ত, শুষে নিল বাংলার পবিত্র মাটি। স্বাধীনতার ঊষা লগ্নে বিজয় সুনিশ্চিত করেই শহীদ হলেন তিনি।
বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে চরম সাহসিকতার জন্য আজও তাঁর রক্তের গন্ধ মিশে আছে বাংলাদেশের বাতাসে। অসামান্য বীরত্বের স্বীকৃতিস্বরূপ ‘বীর শ্রেষ্ঠ’ উপাধিতে ভূষিত করা হয় ওপার বাংলার এই বঙ্গসন্তানকে।
Discussion about this post