সকাল বিকেল চায়ের সাথে যাকে পেলে মন আর কিচ্ছু চায় না, তাকে এই ভূমিতে সাক্ষর রাখতে আসতে হয়েছে বহু বিবর্তনের হাত ধরে। ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায় মধ্য প্রাচ্য থেকে ইরানী ব্যবসায়ীদের হাত ধরে ভারতে আবির্ভাব এই সিঙারার। আবুল ফজল বৈহাকির ‘তারিখ-এ-বৈহাগি’তেও’ এর উল্লেখ পাওয়া গিয়েছে। রাতে ইরানী ব্যবসায়ীদের মরুভূমিতে খাদ্য হিসেবে থাকত মাংসের পুর ভরা সিঙারা। সেই স্বাদ বদলে যায় পার্সিদের আগমনে। আলুর আগমন হতেই সেখানে আরও মশলা মিশিয়ে আলুর পুর ভরা শুরু হয়। পার্সি শব্দ ‘সানবুসাগ’ থেকে সামোসা, ফের তা হয়ে ওঠে বাঙালির সাধের সিঙারা।
নজর ফেরালে দেখা যাবে এই সিঙারাই উত্তর কলকাতার থেকে দক্ষিণ কলকাতায় এসেছে নুন মিশিয়ে। বুঝতে অসুবিধা হতেই পারে। মিষ্টি শিঙাড়া থেকে নোনতা হওয়ার পথে এই দূরত্ব অনেকটাই সাক্ষী। কলকাতায় ঘুরলে এখনও মাংসের পুর ভরা সিঙারা দেখা যাবে। আবার সিঙারায় সব্জির প্রতিনিধিত্ব করেছে ফুলকপি! আলুর বদলে ফুলকপি ভরেও সিঙারা বিক্রির রেওয়াজ আছে গোটা বাংলায়।
তবে দেশের বাইরের একটি খাবারও কিন্তু সিঙারার রসদ হিসেবে জায়গা করে নিয়েছে। সেটি হল চাউমিন! সুদুর চীনা খাদ্য আলাদাভাবে মশলা দিয়ে ভেজে সিঙারার পেটে চালান করে দেওয়া হয়েছে। তবে এদের সবার মধ্যে সেরা স্থান পেয়েছে একমাত্র আলুই। গলানো চকোলেট ভরে তাই ভেজে গরম গরম পরিবেশন, এরকম বাহারি সিঙারার দেখাও আজকাল মেলে। নিত্যনতুনের তালিকায় রয়েছে মাছের শিঙাড়া, পাস্তা কিংবা মাশরুম ভরে শিঙাড়া। রকমারি স্বাদ বদলে সিঙারা আঞ্চলিক ভাবে নিজেকে পরিবর্তন করে এসেছে বহু যুগ ধরে।
বাঙালির আড্ডা ছাড়া চলেনা, হাসির ছলে বলতে গেলে ‘আড্ডা শিল্প’ বাঙালির একান্ত নিজস্বতায় ভরপুর। আর কে না জানে যে সঙ্গী ছাড়া আড্ডা দেওয়াই সম্ভব নয়। সিঙারার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যও এক্কেবারে ঠিক তাই! নিজেও একা নয়, বিবিধ চাটনি এসেছে তার স্বাদ ভাগ করতে। উত্তর কলকাতায় যেমন চল রয়েছে লঙ্কার চাটনি। আবার দক্ষিণ কলকাতায় চলে একধরনের টক মিষ্টি আচারের। পশ্চিম ভারতে আবার সিঙারার ভেতর বাদাম ও ছোলা ভরে তৈরির চল রয়েছে। স্থান-কাল বুঝে সিঙারা বদলেছে তার স্বাদ। কখনও মিষ্টি, কখনও ঝাল আবার কখনও নেহাৎ পাশ্চাত্যর আদব-কায়দায় বিলিয়েছে নিজেকে। বাঙালির সকাল বিকেল ভরিয়ে রেখেছে সে। তাই বারে বারে স্মরণ করতেই হয়, মুচমুচে সাম্রাজ্যের বেতাজ বাদশাকে, যার নাম ‘সিঙারা’।
প্রতিবেদক সায়ক দে
Discussion about this post