দুর্গোৎসব মানেই বাঙালির আবেগ, উচ্ছ্বাস আর ইতিহাসের সঙ্গে মিশে থাকা কিছু অনন্য প্রথা। তেমনই এক সাবেকিয়ানা লালন করে চলেছে উত্তর কলকাতার জোড়াসাঁকোর দাঁ-বাড়ি, যাকে স্থানীয়রা চেনে ‘বন্দুকওয়ালা বাড়ি’ নামেই। কেননা এই বাড়ির প্রাচীন ইতিহাস জুড়ে রয়েছে বন্দুকের ব্যবসার দাপট। বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা নরসিংহ চন্দ্র দাঁ ছিলেন প্রথম বাঙালি ও ভারতীয় বন্দুক ব্যবসায়ী। ব্রিটিশ কোম্পানির প্রতিদ্বন্দ্বী হয়েও তিনি ১৮৫৯ সালে বন্দুক ব্যবসার মধ্যেই শুরু করেছিলেন দুর্গা পুজো। তবে এ বাড়ির দুর্গোৎসব একটু আলাদা, এখানে মা দুর্গা পূজিত হন ‘কন্যা’ রূপে। চারদিনের জন্য উমা যেন ঘরের মেয়ে হয়ে ফিরে আসেন পিতৃগৃহে, আর তাঁকে অভ্যর্থনা জানানো হয় গান স্যালুটে।

পুজোর প্রস্তুতি শুরু হয় রথযাত্রার দিন থেকে। রথপুজোর পর গরান কাঠ পুজো করা হয়, যা প্রতিমার কাঠামোর অংশ হয়েই দেবীর দেহে মিশে যায়। প্রতিপদ থেকেই বোধন শুরু হয়, সপ্তমীর সকালেই দেবীর আগমনের আচার। সপ্তমীর ভোরে কলাবউ স্নান করিয়ে আনেন পরিবারের সদস্যরা, সঙ্গে থাকেন বন্দুক ও তরবারি হাতে প্রহরীরা। কলাবউকে স্থাপন করা হয় ঠাকুরদালানে, আর তখনই গর্জে ওঠে ১৭ ইঞ্চির উইনচেস্টার কামান। কামানের আওয়াজের পরপরই গান স্যালুট দিয়ে জানানো হয় দেবীর আগমনের বার্তা। অষ্টমীর পুজোতেও একইভাবে কামান ও বন্দুকের আওয়াজে ভরে ওঠে দাঁ-বাড়ি। একসময় অবজারভেটরি থেকে ঘড়ি মিলিয়ে সন্ধিপুজোর সময় নির্দিষ্ট করা হত, আজ আর সেই রীতি নেই, তবুও সাবেকি আবহ টিকে আছে সেই স্যালুটের গর্জনে।

এই বাড়ির পুজোতে ভোগের রীতিও আলাদা। দেবীকে অন্নভোগ নয়, দেওয়া হয় লুচি আর পাঁচরকম মিষ্টি। সেই ভিয়েন বসে যায় পঞ্চমীর দিন থেকেই। পরিবারের সদস্যরা নিজেরাই সারা বাড়ি পরিষ্কার করেন, জানলা-দরজা খুলে দেন যেন দেবী অবাধে প্রবেশ করতে পারেন। অষ্টমীতে হয় বিশেষ আরতি, নবমীতে কুমারী পুজো ও যজ্ঞ। দশমীর সকালে মেয়ের বিদায়বেলায় বাড়ির পরিবেশ ভারী হয়ে ওঠে। মহিলারা আঁচল পেতে দাঁড়ান, পুরুষেরা চাল, কড়ি, পান-সুপারি দিয়ে দেন কনকাঞ্জলি। যেন সদ্য বিবাহিত কন্যা শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, তেমনই আবেগে চোখ ভিজে ওঠে সকলের। আগে প্রতিমা কাঁধে করে বাহকরা গঙ্গার ঘাটে নিয়ে যেত, সঙ্গে থাকত মশালবাহী ও সশস্ত্র রক্ষীরা। বিশমনি নৌকোতে মাঝগঙ্গায় হত বিসর্জন, আর নীলকণ্ঠ পাখি উড়িয়ে খবর পাঠানো হত কৈলাসে। আজ আর সেই প্রথা নেই, তবু গান স্যালুটে দেবীর বিদায়ের রেওয়াজ এখনও অটুট।

সময় পাল্টেছে, অনেক কিছুই হারিয়ে গেছে। নেই গরান কাঠের সহজলভ্যতা, নেই বাহক, নেই মাঝগঙ্গার ভাসান বা নীলকণ্ঠ পাখির উড়ান। তবু শতাব্দীপ্রাচীন এই পুজো আজও ইতিহাসের খণ্ডচিত্র তুলে ধরে। দাঁ-বাড়ির দুর্গোৎসব এখনও মনে করায় উনিশ শতকের মহল-সংস্কৃতি, যেখানে আভিজাত্যের সঙ্গে মিশে থাকে আবেগ আর পারিবারিক ভালোবাসা। মা দুর্গা এখানে শুধুই দেবী নন, ঘরের মেয়ে, যাঁকে বন্দুকের গর্জন ও গান স্যালুটে বরণ করা হয়, আর কনকাঞ্জলিতে বিদায় দেওয়া হয় অশ্রুসজল নয়নে। তাই আজও কলকাতার জনবহুল রাস্তার ভিড়ে দাঁড়িয়ে থাকা এই বাড়িটি আলাদা হয়ে ওঠে তার ঐতিহ্যের গৌরবে।
চিত্র ঋণ – শুভজিৎ ঘোষ
Discussion about this post