৫ জুন — ক্যালেন্ডারের পাতায় এক পরিচিত তারিখ – বিশ্ব পরিবেশ দিবস। প্রতি বছর এই দিনটা এলেই কানে ভেসে আসে বহু পুরনো স্লোগান: “গাছ লাগান, প্রাণ বাঁচান”। তবে, পরিবেশ দিবস মানে কেবল গাছ লাগানো বা পোস্টার বানানো নয়। এই দিনটি আসলে আমাদের চেতনায় একটা ধাক্কা — আমরা কোথায় যাচ্ছি? কাদের জন্য বাঁচছি? আর কাদের ধ্বংসকে চুপচাপ মেনে নিচ্ছি?
যেখানে হিমালয়ের বরফ গলে যাচ্ছে কর্পোরেট মুনাফার উষ্ণতায়, সমুদ্রের ঢেউ ঢেকে যাচ্ছে পলিথিনে, আর শিশুদের শ্বাসে ঢুকে পড়ছে ধোঁয়া আর বিষ — সেখানে ‘পরিবেশ সচেতনতা’ শব্দজোড়া যেন খুব নরম আর নির্বিষ শোনায়।
কিন্তু কিছু কণ্ঠ আছে, যারা শুধু সচেতন নয়, প্রতিবাদী — ভাবনায় সাহসী, অভিজ্ঞতায় ক্ষুব্ধ, আবার আশায় দীপ্ত। এমনই চারজন মানুষ, চারটি দৃষ্টিভঙ্গি — চারটি জীবনের গল্প আমাদের আজ ভাবতে শেখায়: পরিবেশ মানে কেবল প্রকৃতি নয়, এটি রাজনীতি, নৈতিকতা, স্মৃতি এবং সহানুভূতিরও প্রশ্ন।
সৌরভ প্রকৃতিবাদী, পরিবেশ আন্দোলন কর্মী বলছেন, “৫ জুন বিশ্ব পরিবেশ দিবস। পরিবেশের ভালো মন্দের সঙ্গে আমাদের জীবনের ভালো মন্দ জড়িয়ে থাকার কথা আরও একবার ভাববার সুযোগ হয় এই দিনটাতে। ক্রমশ দ্রুত বদলে যেতে থাকা জলবায়ু এবং প্রকৃতির সংকট থেকে মুক্তির উপায় চর্চারও একটি বাৎসরিক সুযোগ এসে যায়। গাছ লাগান প্রাণ বাঁচান কিংবা ব্যক্তিগত ভোগ নিয়ন্ত্রণে রাখুন এমন স্লোগান বিশ্ব পরিবেশ সংকট থেকে মুক্তির দিক নির্দেশ আর করতে পারছে না। বরং পরিবেশ-প্রকৃতিকর্মীরা সঠিকভাবেই বিশ্বজুড়ে আওয়াজ তুলছেন আমাদের চাই ব্যবস্থার পরিবর্তন, জলবায়ুর পরিবর্তন নয়। তারা বলছেন ১% অতি সম্পদশালী ক্ষমতাবানেদের জন্য ৯৯% মানুষের বাঁচার অধিকার দাঁওতে লাগানো যায় না। বিশ্ব জোড়া নানা আঙ্গিকে পরিবেশ প্রাণ-প্রকৃতির আন্দোলন ক্রমশ জোর পাচ্ছে। আজকের দিনের পরিবেশ আন্দোলনকে অবধারিতভাবে রাজনৈতিক আন্দোলন হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। বর্তমান লগ্নি পুঁজি, স্যাঙাৎ পুঁজি এবং বিশ্বজোড়া অতি দক্ষিণপন্থী ফ্যাসিস্ট রাষ্ট্র কল্পনার বিরুদ্ধে প্রকৃতি সংলগ্ন জীবনকেন্দ্রিক সমাজতান্ত্রিক ধারণার আড়াআড়ি লড়াই ছাড়া বিশ্ব পরিবেশকে সকলের বাসযোগ্য করে রাখা আর সম্ভব নয়।”
অরিজিৎ চৌধুরী, ট্যুর অপারেটর বলছেন, “পরিবেশ ও পর্যটন একে অপরের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িত। ট্যুরিজম সেখানেই গড়ে ওঠে যেখানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য রয়েছে, যেখানে রয়েছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা। এককথায় সুন্দর পরিবেশ। পাহাড় হোক বা সমুদ্র, কিংবা অভয়ারণ্য এই সব জায়গায় যেটা কমন সেটা হলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুন্দর পরিবেশ। সুন্দর পরিবেশ ততক্ষণ সুন্দর থাকে যতক্ষণ পর্যটকরা নিজেদের দায়িত্ব সম্বন্ধে সচেতন থাকেন। একজন ট্যুর অপারেটর হিসেবে আমি বলতে পারি পর্যটকদের আরো অনেক বেশি দায়িত্বশীল হতে হবে পরিবেশের প্রতি। নিজের শহুরে জীবনের অভ্যেস পাহাড়ে বা সমুদ্রে বয়ে নিয়ে গেলে চলবে না। পাহাড়ে যত্রতত্র জলের বোতল, চিপসের প্যাকেট, প্লাস্টিক ফেলা বন্ধ না করলে পাহাড়ের সৌন্দর্য আর বজায় থাকবে না। পাহাড়ে যে শান্তির খোঁজে মানুষ যায় সেখানে যদি লাউড স্পিকার কিংবা ডিজে বাজে তাহলে সেই শান্তি বোধহয় পাওয়া যাবে না। একইভাবে যদি আমরা সমুদ্র সৈকতে বিয়ারের বোতল, প্লাস্টিকের বোতল সমুদ্রে ফেলা বন্ধ করতে হবে। কারণ এর ফলে সামুদ্রিক প্রাণী, সামুদ্রিক জীবন বিঘ্নিত হচ্ছে। এর পর যদি পরিষ্কার নীলচে জলের সঙ্গে পরিষ্কার সমুদ্র সৈকত যদি আমরা খুঁজে না পাই তার জন্য আমরাই দায়ী থাকবো।”
অদিতি দাসমহাপাত্র, ছাত্রী বলছেন,”প্রায় ৪০ ডিগ্রির বেশি তাপমাত্রার গরমকাল আমাদের এখন গা-সওয়া হয়ে গেছে। এসি, কুলার এখন খুবই স্বাভাবিক ব্যাপার। খুব নিম্নবিত্ত মানুষদের অবস্থাটা অবর্ণনীয়। এমনই এক পরিস্থিতিতে চারদিকে রমরমিয়ে পালন হবে ৫ জুন, বিশ্ব পরিবেশ দিবস। স্কুলে বাচ্চাদের শেখানো হবে গাছ আমাদের বন্ধু। অথচ তার পাড়ার জঙ্গলটা সাফ করে বড় বড় বিল্ডিং তৈরি হলে বাচ্চাটিকে কিছুই বলতে দেওয়া হবে না। আমার এলাকায় আগে প্রায় ৬ খানা পুকুর ছিল। এখন একটাও নেই। বাড়ি থেকে দিল্লি রোড, প্রায় ৩ কিমি রাস্তার দুই ধারে বাঁশবাগান ছিল… কত নাম না জানা পাখি ছিল… এখন কিচ্ছু নেই। কংক্রিটের জঙ্গলে আমরাই রাজত্ব করছি আর দু’দিন অন্তর অন্তর শ্বাসকষ্ট নিয়ে জেরবার হয়ে যাচ্ছি। শুধুমাত্র এক দু’দিনের পরিবেশ সচেতনতা নয়, বরং চাই রোজকার জীবনযাপনে প্রকৃতি-সংবেদী ভাবনা। এবছর পরিবেশ দিবসে আমাদের শপথ হোক এটাই।”
অন্বয় ব্যানার্জী, অভিনেতা বলছেন, “পরিবেশ দিবস, ছোটবেলা থেকে গাছ লাগানো, স্কুলের মাঠ পরিস্কার করা, ইত্যাদি বিভিন্ন ‘activity’ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিলো দিনটা। বয়স বাড়লে ভাবনার ধারা পাল্টায়, তাই আজ যেটুকু নিয়ে কথা বলবো; তা বিশ্ব-উষ্ণায়ন, প্লাস্টিক দূষণ, বরফ গলে যাওয়া; ইত্যাদির বাইরে।
আমার বা আমাদের চারপাশ অশান্ত হয়ে রয়েছে আজ, মানুষ মানুষকে ভাগ করছে ধর্মের ভিত্তিতে, জাতের ভিত্তিতে, গোটা দেশ মেতে উঠেছে উন্মত্ততায়, ইকলাখ, আফরাজুল, আসিফা, অভিজিৎ রায়, ওয়াশিকুর রহমান বাবু; নামগুলো জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছে, দিনের পর দিন এমন নামের সংখ্যা বাড়ছে, আর আমরা যারা একটা সুস্থ পরিবেশের স্বপ্ন দেখছি, আমরা শুধু চারটে গাছ লাগিয়েই ক্ষান্ত থাকবো? পরিবেশকে মানবিক, সংবেদনশীল করে তুলতে একটু ‘মানব-জমিন আবাদ’ করে সোনা ফলানোর চেষ্টা করবো না?
চারটি মানুষ, চারটি প্রেক্ষাপট — কিন্তু বার্তাটি একটাই। বিশ্ব পরিবেশ দিবস কেবল একদিনের প্রতীকী কর্মসূচি নয় — এটা নিজের ভিতরটা নাড়া দেওয়ার দিন। এবার হয়তো আমাদের ভাবার পালা — এই বছরে আমরা কতটা প্রকৃতি সংরক্ষণ করলাম? আর কতটা মানুষ সংরক্ষণ করতে পারলাম?
Discussion about this post