শীতকাল মানেই বাঙালির কাছে উৎসবের মরশুম। ক্রিসমাস থেকে শুরু করে ইংরেজি নতুন বছরের উদযাপনে এই সময় মেতে ওঠেন সবাই। আর তার রেশ পড়ে খাবারের প্লেটেও। নলেন গুড়, জয়নগরের মোয়া থেকে শুরু করে ক্রিসমাসের কেক, কী নেই এই তালিকায়। তবে জানেন কী, ভারতের কোথায় প্রথম তৈরি হয়ছিল ক্রিসমাসের কেক? কেরালায়, ১৮৮৩ সালে। দক্ষিণ ভারতের মালাবার উপকূলবর্তী অঞ্চলে কেকের এই যাত্রার শুরুটা একেবারেই আকর্ষণীয়।
সময়টা ১৮৮৩ সালের নভেম্বর মাস। ব্রিটিশ শাসিত ভারতে তখন স্কটল্যান্ডের এক বণিক, মার্ডক ব্রাউন, ব্যবসা করতেন। তিনি কেরালার মালাবারে দারুচিনি চাষের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বড়দিনকে সামনে রেখে কেকের খোঁজে তিনি পৌঁছলেন স্থানীয় রয়্যাল বিস্কিট ফ্যাক্টরিতে। দোকানের মালিক ছিলেন মাম্বলি বাপু। মার্ডক তাকে একটি কেক বানানোর অনুরোধ করেন।
তখন ভারতে কেকের প্রচলনই হয়নি। তাই কেক তৈরির কোনো রেসিপি জানতেন না বাপু। তবে ব্রেড ও বিস্কুট তৈরিতে দক্ষ ছিলেন তিনি। এই দক্ষতাই তাকে সাহসী করে তোলে নতুন কিছু চেষ্টা করার জন্য। মার্ডক তার সঙ্গে ব্রিটেন থেকে আনা একটি নমুনা কেকের বর্ণনা ভাগ করে নেন। প্রতিটি ধাপ বুঝিয়ে দেন।
মাম্বলি বাপু ব্র্যান্ডির বদলে স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করেন। তিনি কাজু, আপেল ও কলা দিয়ে এক বিশেষ কেক তৈরি করার সিদ্ধান্ত নেন। ফলাফল হয় অসাধারণ। সম্পূর্ণ ভারতীয় উপকরণ দিয়ে তৈরি প্রথম ক্রিসমাস কেকের স্বাদে মুগ্ধ হয়ে পড়েন মার্ডক ব্রাউন। কেকটি পরিচিত হয়ে ওঠে প্লাম কেক নামে। খুশি হয়ে এক ডজন কেকের অর্ডার দিয়ে ফেলেন তিনি।
এভাবেই মাম্বলি বাপুর হাত ধরে ভারতে ক্রিসমাস কেক তৈরির সূচনা ঘটে। সেই রয়্যাল বিস্কিট ফ্যাক্টরির ঐতিহ্য এখনো টিকে আছে। চার প্রজন্ম ধরে চলে আসা এই বেকারি আজ ভারতের বড়দিন উদযাপনের অংশ হয়ে উঠেছে। মাম্বলি বাপু শুধু ভারতের প্রথম কেক প্রস্তুতকারকই নন, প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় সৈন্যদের কাছেও কেক ও মিষ্টি রপ্তানি করেছিলেন। তার পরিবার এই ঐতিহ্য আজও বহন করে চলেছে। তার ভ্রাতুষ্পুত্রের নাতি, প্রকাশ মাম্বলি, আজ এই ঐতিহাসিক বেকারিটি পরিচালনা করেন।
তাদের ঐতিহ্য শুধু কেরালায় সীমাবদ্ধ নেই। দেশের বিভিন্ন শহরে কেক পাঠানো হয় কুরিয়ারের মাধ্যমে। মুম্বাই, কলকাতা, চেন্নাই ও ব্যাঙ্গালুরুর মতো শহরগুলোর ক্রেতারা মাম্বলি পরিবারের কেকের স্বাদে মুগ্ধ। কেরালা আজ ক্রিসমাস কেকের জন্য বিখ্যাত এক কেন্দ্র হিসেবে গড়ে উঠেছে। সেই রাজ্যের প্রায় ১৮ শতাংশ জনগণ খ্রিস্টধর্মাবলম্বী। তাই উৎসবের মরসুমে কেকের চাহিদা থাকে তুঙ্গে। মাম্বলি বেকারির কেক বিক্রি শুরু হয় বড়দিনের আগের সপ্তাহে। ইংরেজি নববর্ষ পর্যন্ত চলে এই বিক্রি। এভাবেই মাম্বলি পরিবারের কেক কেবল একটি খাবার নয়, হয়ে উঠেছে ঐতিহ্য ও সংস্কৃতির অংশ। ভারতের ক্রিসমাস কেকের গল্প যেন বাপুর তৈরি সেই প্রথম কেকের সুগন্ধ ছড়িয়ে চলেছে আজও।
Discussion about this post